অবাধে চলছে ক্লিনিক-হাসপাতালের টেস্ট বাণিজ্য
গাজীপুরের কালীগঞ্জে বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের টেস্ট বাণিজ্যের মুখে লাগাম টানা যাচ্ছে না কোন ভাবেই। সেবার মান, পরিবেশ ও খরচের দোহাই দিয়ে এসব হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিকরা কিছু অসৎ চিকিৎসকের সঙ্গে আতাত করে মনগড়া মূল্য আদায় করেই যাচ্ছে বলে স্থানীয়দের দীর্ঘ দিনের অভিযোগ। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেউ-ই এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপও নিচ্ছে না। এ সুযোগে নানা অজুহাতে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিকরা অবাধে চালাচ্ছে টেস্ট বাণিজ্য।
সরকারী হাসপাতাল ও বেসরকারী ক্লিনিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারী হাসপাতাল ও বেসরকারী ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতালে বিভিন্ন টেস্টের খরচে আকাশ পাতাল ব্যবধান। সরকারী হাসপাতালে ডোপ টেষ্ট ৯০০, প্লাটিনেট কাউন্ট ৫০, ইউরিন ২০, প্রেগনেন্সি টেষ্ট ৮০, ভিডিআরএল ৫০, উইডাল টেষ্ট ৫০, সিআরপি ১৫০, আলট্রাসনোগ্রাফি অব অ্যাবডোমেন করতে ৪৫০ টাকা লাগে। ইসিজি ফি সারাদেশে সরকারীতে ৮০ টাকা।
এছাড়া সরকারি হাসপাতালে এক্সরে শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী ২০০-৪০০,আল্ট্রাসনোগ্রাম ২২০ টাকা থাকলেও বেসরকারি সেবা দান কারী প্রতিষ্ঠানে দ্বিগুণ থেকে ১০গুণ অতিরিক্ত মূল্য আদায় করা হচ্ছে। সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকারভেদে টেষ্ট করাতে বিপুল পরিমান অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি জামিল চক্ষু হাসপাতালে সেবা নিতে আসা ফুলদী গ্রামের হাসনে হেনা (৩২) অভিযোগ করে বলেন চোখের চিকিৎসা করাতে এসে রক্তের নানাবিধ পরিক্ষা করাতে হচ্ছে। অসহায়ের মত করে বলেন, এখন গাদা গাদা টেষ্ট করাব না কি ঔষধ কিনব?
সরেজমিনে দেখা যায়, কালীগঞ্জের কিছু বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার টেস্ট বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে নোয়াপাড়া পপুলার হাসপাতাল, নুর জেনারেল হাসপাতাল, নিউ ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতাল, কালীগঞ্জ ডায়াগনস্টিক এন্ড জেনারেল হাসপাতাল, বিসমিল্লাহ ডায়াগনস্টিক এন্ড ট্রমা সেন্টার, শাপলা ডায়াগনস্টিক, আবেশমনী ডায়াগনস্টিক, কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল হাসপাতাল,নুবহা জেনারেল হাসপাতাল,আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল, গ্লোবাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নাগরী ডায়গনাষ্টিক সেন্টার, উলুখোলা ডায়গানাষ্টিক ও পূর্বাচল ডায়াগনস্টিক টেস্ট বাণিজ্যে শীর্ষে।
সরকারি হাসপাতালের নানা সীমাবদ্ধতা, নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মান, যন্ত্রপাতির দাম, দক্ষ লোকবলের অজুহাত দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান উচ্চমূল্য আদায় করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে বেসরকারী ক্লিনিক-হাসপাতালের মালিকরা সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারদের নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন ভাবে ম্যানেজ করে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে টেষ্ট লিখতে বলেন। যার ফলে তাদের এসকল আচরণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা কখনো মাথা ঘামান না।
১৯৮২ সালে সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানে রোগ নির্ণয়ের একই ফি নির্ধারণ করে 'মেডিকেল প্র্যাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এন্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্সের' আওতায় নীতিমালা প্রণয়ন করে। কিন্তু ২ বছরের মাথায় তা বিলুপ্ত করা হয়। এরপর থেকেই বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো টেস্ট বাণিজ্যে নেমে পড়ে।
কমিশনের লোভে কিছু লোভী চিকিৎসকও কারণে অকারণে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দিয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে একেকটি টেস্টের জন্য বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশন পান চিকিৎসক। এ প্রবণতায় রোগীরা খুবই অসহায় এবং বাড়তি টেস্টের খরচে তারা সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে।
অনুসন্ধানে আরোও জানা যায়, কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষার ব্যয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আকাশ-পাতাল ব্যবধান হয়। কমিশন প্রদান করে অতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করতেই বিভিন্ন পরীক্ষার চার্জ প্রকৃত খরচের চেয়ে অনেক গুণ বেশি নেওয়া হয়। বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়গনাষ্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের গাজীপুরের মূল্য তালিকা অনুযায়ী কালীগঞ্জের সকল বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতালে টেষ্টের মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ ডায়াগনাস্টিক এন্ড জেনারেল হাসপাতালের সত্বাধিকারী ডাঃ মোঃ আরমান হোসেন বলেন, পরীক্ষার মূল্য লাগামহীন হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে রি-এজেন্ট ও যন্ত্রপাতি আমদানি নির্ভর। রি-এজেন্ট বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আমদানী করে থাকে। তাদের নিকট হতে আমরা ক্রয় করে থাকি। হাত বদলের কারনে খরচও বৃদ্ধি পায়। সরকারী ভাবে যদি অমদানী করা হতো তাহলে মূল্যও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ এস এম মনজুর-ই-এলাহী প্রতিবেদককে জানান, বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে আমি মূল্য তালিকা দেখেছি। সকল প্রতিষ্ঠানকে সর্তক করেছি তারা যাতে সর্বশেষ আপডেট মূল্য তালিকা অনুযায়ী সেবা নিশ্চিত করে। টেস্টের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা আছে কি-না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রতিবেদককে বলেন এ সকল বিষয় পরিচালক (হাসপাতাল) দেখেন, আপনি ওনার সঙ্গে কথা বলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) শেখ দাউদ আদনান মোবাইল ফোনে প্রতিবেদককে বলেন, বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতাল মালিকদের এই ধরনের মূল্য তালিকা সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। টেষ্টের মূল্য নির্ধারনের বিষয়টি মন্ত্রনালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি দেখবে।
এএজেড