স্ট্যাম্পে লিখে মহাসড়ক বিক্রি করলেন হকার্স লীগ নেতা
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী যেখানে মহাসড়কের সীমানা হতে ১০ মিটারের মধ্যে হাটবাজার ও বানিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা নিষেধ। সেখানে খোদ মহাসড়কের ওপর দোকান গড়ে তা স্ট্যাম্পে লিখে দানপত্র করে প্রতারণার মাধ্যমে মহাসড়কের দোকানের মালিকানা হস্তান্তর করেছেন সাভারের এক হকার নেতা। স্ট্যাম্পে দান পত্র লিখলেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তা বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রতারণার শিকার একাধিক ভুক্তভোগী।
মহাসড়ক বিক্রির মত এমন এলাহী কান্ড ঘটিয়েছেন সম্প্রতি মনোনীত সাভার উপজেলা হকার্স লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আব্দুল কাদের মোল্লা। তিনি লালমনিরহাট জেলার মৃত গনি মোল্লার ছেলে এবং সাভার পৌরসভার স্মরণিকা এলাকার নূর মোহাম্মদের বাড়ির ভাড়াটিয়া।
স্ট্যাম্পে লিখে মহাসড়ক বিক্রির এমন অবাক কান্ড সবাইকে হতবাক করেছে। শুধু বিক্রি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। নিচ্ছেন দৈনিক ভাড়া ও মাসিক হারে চাঁদাও। আবার ছয় মাস পর পর তা রিনিউ করতে হয়, না হলে পুরাতন ব্যাক্তিকে উঠিয়ে বসানো হয় নতুন কাউকে। এভাবেই চলছে তার মহাসড়ক বিক্রির মহোৎসব।
অভিযোগ আছে, সাভারের বৃহৎ ফুটপাত চক্রের হোতা আব্দুল কাদের মোল্লা স্থানীয় এক কাউন্সিলর, সাভারের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, পল্লী বিদ্যুতের সংশ্লিষ্ট অফিসার, হাইওয়ে ও থানা পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে সাধারণ হকারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে নিজেই ভোগ করেন।
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের ঢাকা আরিচা মহাসড়কের দ্বি-মুখী ফুটপাত জমি বিক্রয়ের মত স্ট্যাম্পের মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তর করে ভাড়া দিয়ে প্রায় ৪ শতাধিক হকার দোকানির কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা এক কালীন আদায় করেছেন। যা তাদের দানপত্রের ভিতরে টাকার অংক উল্লেখ করা হয়নি। এটাই তার দানপত্রের কৌশল বলে জানায় ভুক্তভোগীরা।
বিপুল পরিমাণ চাঁদা আদায় কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় কাদের মোল্লার রয়েছে একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী। এই দলের অন্যতম সদস্যরা হলেন- জহির, রমজান, পাবেল ওরফে তোতলা পাভেল, আনোয়ার, সুশান্ত, কালা শরীফ, জিয়া, ধলা শরীফ, জুয়েল, ইসরাফিল ও মানিক।
কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল কাদের মোল্লা সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার অনেক হকারকে ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিন পাতার স্ট্যাম্পে লিখে দান পত্র করে দিয়েছেন। স্ট্যাম্পে দান পত্র লিখলেও টাকার কথা উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ করা হয়নি দৈনিক হারে নেওয়া লাইনম্যানের বেতনের খরচ বাবদ ৫০ টাকা, পল্লীবিদ্যুতের লাইট খরচ বাবদ ৩০ টাকা, হকার নেতা ও প্রশাসন খরচ বাবদ ১০০ টাকা সহ সর্বমোট ১৮০ টাকা এবং ছয় মাস পর পর রিনিউ করার কথাও।
স্ট্যাম্পে দানপত্র নিয়ে প্রতারণার শিকার মোঃ বুলবুল ঢাকা প্রকাশকে বলেন, আমি পেশায় একজন হকার ব্যবসায়ী। গতবছর (২০২২ সালে) মার্চ মাসে সাভারের হকার সিন্ডিকেট নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার কাছ থেকে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাজ্জাক মাছ বাজারের সামনে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের 'সাড়ে তিন হাত' ফুটপাত দোকান আমার বড় ভাই মোঃ সুমনের নামে ক্রয় করি। যা তিনশো টাকার স্ট্যাম্পে অত্যান্ত চতুরতার সাথে টাকার অংক উল্লেখ না করে ফুটপাতের দোকানের মালিকানা হস্তান্তর করেন আব্দুল কাদের মোল্লা।
দোকান নেওয়ার পর নিয়মিত লাইনম্যানের বেতনের খরচ বাবদ ৫০ টাকা, পল্লীবিদ্যুতের লাইট খরচ বাবদ ৩০ টাকা, হকার নেতা ও প্রশাসন খরচ বাবাদ ১০০টাকা সহ সর্বমোট ১৮০ টাকা করে প্রদান করে আসছি । কিন্তু ছয়মাস পরে হঠাৎ করে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে আবারও এককালীন টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে আমাদের দোকান বন্ধ করে দেয় আব্দুল কাদের মোল্লা। পরে দোকান রিনিউ করার জন্য তার ছেলে জহিরুল ইসলামের শরণাপন্ন হয়ে তাঁর নিকট ২০ হাজার টাকা দেই। পরে দোকান খুলতে দেয়।
তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার রিনিউ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। বর্তমানে আমার ব্যাবসায়িক অবস্থা ভালো না হওয়ায় তাদেরকে টাকা না দেওয়ায় আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। গত ১২ ফেব্রয়ারী আমি প্রতিদিনের ন্যায় দোকান খুলতে গেলে আব্দুল কাদের মোলার নেতৃত্বে জুয়েল ও কাজল সহ অজ্ঞাত ২০-৩০ জন সন্ত্রাসী মিলে আমাকে মারধর করে আমার মালামাল তাদের অফিসে নিয়ে যায়। এরপর থেকে কোনো ভাবেই আমার দোকান করতে পারছি না। আমি দোকান করলে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলবে বলে হুমকি প্রদান করছে। প্রাণের ভয়ে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। সব মিলিয়ে আমি অনেক অসহায় জীবন যাপন করছি।
অন্য আরেক ভুক্তভোগী শাহিন শেখ ঢাকা প্রকাশকে বলেন, আমি দুই বছর আগে রাজধানীর গুলিস্থান থেকে পাইকারি জামা-কাপড় এনে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফুটপাতে খুচরা বিক্রি শুরু করি। সেখানে প্রথম দিনেই আমার দোকান তুলে দেয় আব্দুল কাদের মোল্লার লোকজন। পরে কাদের মোল্লা আমাকে তার অফিসে গিয়ে দেখা করতে বলেন। সেখানে দেখা করতে গেলে তিনি ফুটপাতে দোকান করতে বিভিন্ন দ্প্তর ও প্রশাসনের খরচ বাবদ একটি চার্ট ধরিয়ে দেন।
পরে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এককালীন, মাসিক ও দৈনিক চাঁদা দাবি করে। পরে ফুটপাতের জায়গা দলিল করার জন্য ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আমি তাকে ৩০ হাজার টাকা প্রদান করতে বাধ্য হই। এবং তাদের দেওয়া চাট অনুযায়ী লাইনম্যানের বেতনের খরচ বাবদ ৫০ টাকা, পল্লীবিদ্যুতের লাইট খরচ বাবদ ৩০ টাকা, হকার নেতা ও প্রশাসন খরচ বাবদ ১০০টাকা সহ সর্বমোট ১৮০ টাকা করে প্রদান করতে থাকি।
এভাবে ছয়মাস পর পর দোকান ভেঙ্গে দিয়ে নতুন জায়গায় দোকান বরাদ্দের কথা বলে ৩০ হাজার টাকা করে দিতে বাধ্য করেন। কিন্তু অন্যান্য হকারদের স্ট্যাম্প দিলেও আমাকে দেয়না। পরে আমি স্ট্যাম্পের কথা বললে দিবে দিবে করে ঘুড়াতে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে হকার সমবায় সমিতি লিঃ এর নাম করে কাদের মোল্লা ও তার লোকজন মিলে প্রত্যেক হকারের নিকট হতে ৬০ হাজার টাকা করে নিয়ে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার লোভ দেখাচ্ছেন এবংকি এখানকার অনেক রাজনৈতিক নেতার কর্মীকেও এই দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কথা হচ্ছে। আমি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আমার দোকান উঠিয়ে দিয়ে সেখানে অন্য একজনের দোকান বসিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে আমি থানায় অভিযোগ করলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এরপর থেকে কাদের মোল্লা ও তার রোকজন মিলে অনবরত আমাকে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান কালে কাদের মোল্লার পালিত সন্ত্রাসী বাহিনীর অন্যতম সদস্য লাইনম্যান জুয়েল আমাকে কিল ঘুষি ও থাপ্পর মেরে স্থান ত্যাগ করতে ভয়-ভীতি দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। পরে ভয়ে আমি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে সাভার মডেল থানায় গিয়ে আবারও অভিযোগ দায়ের করি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা ঢাকা প্রকাশকে বলেন, আমি স্ট্যাম্পে চুক্তি করে দোকানের মালিকানা হস্তান্তর করেছি। কিন্তু আমি কোন টাকা নেইনি। আর ওখান থেকে আমি কোন প্রকার চাঁদা তুলি না। সরকারি জায়গা স্ট্যাম্পে চুক্তি করে মালিকানা হস্তান্তর করতে আপনি পারেন কিনা, এমন প্রশ্নের তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ৩ শিমুলতলা জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো: হারুন অর রশিদ ঢাকা প্রকাশকে বলেন, আমরা অনেকবার অভিযান চালিয়েছি। ওরা আসলে সরাসরি বৈদ্যুতিক তার থেকে হুক লাগিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয় না। কাছাকাছি মার্কেটের মিটার থেকে সংযোগ দেয়। আমরা অভিযান চালিয়ে কয়েকবার সেইসব লাইন কেটে দিয়েছি।
মিটার থেকে লাইন নিলেও তো সেটা অবৈধ, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে ফুটপাতে দোকান বসাই তো অবৈধ। প্রশাসন যদি ফুটপাতের দোকান উচ্ছেদ করে দেয় তাহলে তো লাইটের দরকার হয় না। তাই আমিও ফুটপাতের দোকান উচ্ছেদে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
স্ট্যাম্পে লিখে সড়ক বিক্রির ব্যাপারে সড়ক ও জনপদের কল্যাণপুর উপ-বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো: মারুফ হাসান বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য আমার জানা নেই, এ কথা আমি প্রথম শুনলাম। আমি তো স্ট্যাম্পের লিখা দেখে অনেকটা অবাক হয়েছি। এই সড়কের দায়িত্ব নেওয়ার পরে আমি নিজে চারবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু ভ্রাম্যমান দোকান গুলো অভিযানের দুইদিন পরে তারা আবার বসে পরে। যার ফলে আমাদের অভিযান সফল হয় না।
তিনি আরও বলেন, সরকারি মহাসড়কের মধ্যে যদি কোনো ধরনের স্থাপনা তৈরী করা হয়, তা আসলে সম্পূর্ণ অবৈধ। আমি অতিদ্রুত বিষয়টি তদন্তের জন্য লোক পাঠাবো। স্ট্যাম্পে এই জায়গাটা আমাদের মহাসড়কের সাথে সর্ম্পকৃত কিনা। তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
এ ব্যাপারে সাভার হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আজিজুল হক ঢাকা প্রকাশকে বলেন, ওটা থানা পুলিশ দেখে। একবার আমরা অভিযান চালাতে গিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। তারপর থেকে আমরা আর একা অভিযান চালাই না। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সাথে সমন্বয় করে অভিযান চালাই।
হাইওয়ে থানা পুলিশের নামে চাঁদা তোলা হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এরকম কোন কিছুর সাথে আমি বা আমরা যুক্ত নই। ওইদিকে আমরা যাই না। আব্দুল কাদের মোল্লার চাঁদাবাজির ব্যাপারে জানতে চাইলে সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, এমন চাঁদাবাজির কোন সুনিদৃষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে মামলা নেওয়া হবে।
এএজেড