৩২ বছর পরও নির্মিত হয়নি সেতু, দুর্ভোগে চালক-যাত্রীরা
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার সংযোগস্থল চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী নদীতে একটি সেতুর নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। অথচ চন্দ্রঘোনায় ফেরি চালুর ৩২ বছর পরও কর্ণফুলী নদীর ওপর সেতু নির্মিত হয়নি। সেতুর অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এই পথে চলাচলকারী ২ লক্ষাধিক মানুষকে। এই ফেরিঘাট দিয়ে প্রতিদিন সেনাবাহিনীর গাড়িসহ শত শত যাত্রীবাহী বাস, জিপ, অটোরিকশা ও পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করছে। কিন্তু এই ঘাটে একটি মাত্র ফেরি হওয়ায় একসঙ্গে বেশি যানবাহন পারাপার সম্ভব হয় না। ফলে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন চালক ও যাত্রীরা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ ১৯৮৪ সালে চন্দ্রঘোনায় ফেরি সার্ভিস চালু করে। এশিয়ার বিখ্যাত কর্ণফুলী কাগজ কলের কাঁচামাল আহরণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত বাঁশ, গাছ, মৌসুমি ফলমূল, তরকারিসহ বিভিন্ন মালামাল প্রতিদিন এই ফেরি দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বান্দরবান ও রাজস্থলী থেকে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই-রাঙামাটি জেলার সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা লাঘবে এই ফেরি যথেষ্ট নয়। বান্দরবান থেকে খুব ভোরে বাসে উঠে চট্টগ্রাম বা রাঙামাটির উদ্দেশে রওনা দিলেও ফেরি সমস্যার কারণে যাত্রীদের যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
এলাকাবাসী জানান, এই ঘাটে একটি মাত্র ফেরি হওয়ায় নদীর এক পাড়ে ফেরি থাকলে অপর পাড়ে গাড়ির দীর্ঘ লাইন হয়। ফেরিতে উঠতে কমপক্ষে দেড় থেকে ২ ঘন্টা পিছিয়ে পড়তে হয়। দ্রুত ফেরি ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেকে দুর্ঘটনায় পড়েন।
এদিকে চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটে একটি মাত্র ফেরি প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলাচল করে। বাকি সময়ে সম্পানই ভরসা। ফেরি স্বল্পতায় কৃষি পণ্য, মৌসুমি ফল, জরুরি রোগী নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় দুই পাড়ের বাসিন্দাদের।
সোমবার (২৩ জানুয়ারি) সরেজমিনে ফেরিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে রাজস্থলী ও বান্দরবান থেকে আসা ১৫-২০টি পণ্যবাহী ট্রাক, জিপ ও টেম্পো লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় চট্টগ্রাম শহরমুখী ট্রাকচালক নুরু ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, পণ্য নিয়ে ফেরিঘাটে তাদের অনেক সময় ১-২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় কাঁচা ফলমূল প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু হলে এমনটি হতো না।
জানা যায়, ২০১৭ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পরিদর্শনে আসলে এখানে একটি সেতু অথবা টানেল নির্মাণের আশ্বাস দেন। কিন্তু আশ্বাসে অর্ধ যুগ পার হলেও কর্ণফুলী নদীতে সেতু নির্মাণ বাস্তবায়ন হয়নি।
অথচ এই ফেরিঘাটে একটি সেতু নির্মিত হলে সড়ক পথে রাজস্থলী ও বান্দরবানের সঙ্গে চট্টগ্রাম এবং রাঙামাটির যাতায়াত দূরত্ব প্রায় ১ থেকে ২ ঘণ্টা কমে আসবে। একই সঙ্গে কাপ্তাই- রাঙ্গুনিয়া ও রাজস্থলী তিন উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হতো। পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার হবে এই তিন উপজেলায়। তবে সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
চন্দ্রঘোনা দোভাষী বাজারের আবু তালেব নামের তারকারি ব্যবসায়ী জানান, তিনি গত ১৮ বছর ধরে রাজস্থলী ও বান্দরবান থেকে ফলমূল ও তরকারি কিনে এনে রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন হাটবাজারে পাইকারি বিক্রি করছেন। রাঙ্গুনিয়াসহ চট্টগ্রাম ও দেশের বড় বড় শহরগুলো থেকে প্রতিদিন শত শত ব্যবসায়ী রাজস্থলী ও বান্দরবান থেকে শাক-সবজি, ফলমূল কিনে নেন। কিন্তু কর্ণফুলী নদী পারাপারের সময় চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটে প্রায় সময় লাইন দিয়ে বসে থাকতে হয়। এতে অনেক সময় পণ্য পচে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ব্যবসায় আশানুরূপ লাভ থাকছে না।
এ প্রসঙ্গে চন্দ্রঘোনা ইউপি চেয়ারম্যান ইদ্রিস আজগর জানান, ১৯৯১ সালে তৎকালীন সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী কর্ণেল অলি আহমদ একাধিকবার চন্দ্রঘোনায় আসেন এবং জনগণের দাবির মুখে লিচুবাগান এলাকায় কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, 'রাঙ্গুনিয়ার সাংসদ ও মাননীয় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও গত ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী জনসভায় চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। ২০১৭ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পরিদর্শনকালে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এখনো কোনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। আশা করব উনারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা দ্রুত কার্যকর করবেন।'
রাইখালী ইউপি চেয়ারম্যান মংক্যাই মারমা বলেন, রাইখালি ইউনিয়নে রয়েছে চন্দ্রঘোনা থানা, কাপ্তাই উপজেলা পশু সম্পদ কার্যালয়। রাজস্থলীতে রয়েছে কয়েকটি সেনা ক্যাম্প, নারানগিরি সরকারি স্কুল। এ ছাড়াও রয়েছে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। কিন্তু সেতু না থাকায় নদীর এই পাড়ের পুরো এলাকা পিছিয়ে রয়েছে।
এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রকৌশলী দিদারুল আলম বলেন, 'সম্প্রতি চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু নির্মাণের নিমিত্তে বাংলাদেশ সেতু বিভাগের ৩ সদস্যের একটি টিম চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন টিম চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট এলাকায় সেতু নির্মাণের জন্য সেতু বিভাগের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এখন চলছে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই। এরপর হয়তো খুব শীঘ্রই চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটে সেতু নির্মাণের কাজ আরম্ভ হতে পারে।
এসআইএইচ