থামছে না সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, নেপথ্যে মাদক ও গরু ব্যবসা!
লালমনিরহাটের বিভিন্ন সীমান্তে দুই মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) নির্যাতনে ৮ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ জনই বাংলাদেশি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর শত বাধা উপেক্ষা করে চোরাকারবারিরা সীমান্তে যাচ্ছে মাদকের পাশাপাশি ভারতীয় গরু আনতে।
শীতের শুরুতে ভারতীয় গরু ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সীমান্তগুলোতে চোরাচালানকারীদের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। রাতের রাজা নামে পরিচিতি দইখাওয়ার ভুট্টুর নেতৃত্বে বিজিবি, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের নাম ভাঙিয়ে তোলা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
জানা গেছে, গত ৯ নভেম্বর জেলার আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ি সীমান্তে ভারতীয় গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ওয়াসকুরুনী ও আয়নাল হক নামে দুই বাংলাদেশি। গত ২৭ নভেম্বর হাতীবান্ধার টংভাঙ্গা ইউনিয়নের গেন্দুকড়ি সীমান্তে বিএসএফের নিযার্তনে নিহত হন সাদ্দাম হোসেন নামে এক গরু ব্যবসায়ী।
গত ১৪ ডিসেম্বর জেলার পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতনে সীমান্তে নিহত হয় ভারতীয় এক গরু ব্যবসায়ী। তার এক দিন পর ১৫ ডিসেম্বর ওই উপজেলায় বিএসএফের নির্যাতনে শাহাদাত হোসেন নামে এক গরু ব্যবসায়ী নিহত হয়।
গত ২৯ ডিসেম্বর জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোলাপাড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে সাদিকুল রহমান সাদিক ও নাজির হোসেন নামে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়। একই দিনে জেলার আদিতমারী উপজেলায় গরু চোরাচালনকারীদের হামলায় একজন গ্রাম পুলিশও আহত হয়। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর রাতে বুড়িমারী সীমান্তে বিএসএফ গুলিতে বিপুল মিয়া (২৩) নামে বাংলাদেশি এক রাখাল নিহত হয়।
বিজিবির ব্যাপক কঠোরতার পরও সীমান্তে কীভাবে যাচ্ছে চোরাচালানকারীরা? এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, সীমান্তে এলাকাভিত্তিক চোলাচালানকারীদের একজন করে লাইনম্যান রয়েছে। ওই লাইনম্যান এক একটি করে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। সেই সিন্ডিকেটের কোনো সদস্য বিজিবির গতি বা অবস্থান লক্ষ্য করেন।
বিজিবি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় টহলে গেলেই তারা সীমান্তে গিয়ে মাদক ও ভারতীয় গরু নিয়ে আসে। সেই গরু আনতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে একের পর এক বাংলাদেশি। বিনিময় মাদক ও গরু ব্যবসায়ীদের ওই সিন্ডিকেটকে গরু প্রতি কমিশন দিতে হয়। বিজিবি, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের নাম ভাঙিয়ে সেই টাকা তুলে থাকেন কথিত লাইনম্যানরা।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার ঠ্যাংঝাড়া, ফকিরপাড়া, দোলাপাড়া, সিঙ্গিমারী, গেন্দুকুড়ি, দইখাওয়া, আমঝোল ও ভেলাগুড়ি সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন মাদকের সাথে শত শত ভারতীয় গরু আসছে। এসবের এলাকাভিত্তিক রয়েছে লাইনম্যান। যাদের মধ্যে সিঙ্গিমারীতে সেকেন্দার হোসেন, দইখাওয়ায় ভুট্টু, মোতালেব, আমঝোল এলাকায় আনিছুর, মতিয়ার, ভেলাগুড়িতে জাহিদ ও সুজন, ঠ্যাংঝাড়ায় নজরুল, ফকিরপাড়ায় লুৎফর ও দোলাপাড়ায় বেলাল হলো ওই লাইনম্যান সিন্ডিকেটের মুলহোতা। তাদের মাধ্যমে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা তোলা হয় গরু ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। সেই টাকা অংশভেদে চলে যায় সিন্ডিকেটের বাকি সদস্যদের কাছে।
কথিত রয়েছে, দইখাওয়ার এলাকার ভুট্টুর সঙ্গে প্রশাসনের দুই একজন কর্মকর্তা ও কতিপয় সাংবাদিককের সখ্যতা থাকায় তিনি হয়েছেন লাইনম্যানের সর্দার। তাকে অনেকেই 'রাতের রাজা' বলে চিনেন। 'রাতের রাজা' নামে পরিচিতি এই ভুট্টুর নেতৃত্বে পুরো সীমান্তজুড়ে চলছে মাদক ও ভারতীয় গরুর জমজমাট ব্যবসা। বেশ কিছুদিন আগে ওই ভুট্টুর বাড়িতে তল্লাশি করে বিজিবি। এ সময় বিজিবির সদস্যের প্রচন্ড গালাগালি করে ভুট্টু ও তার ভাইরা।
আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর সীমান্তেও রয়েছে মাদক ও গরু পাচারকারী সিন্ডিকেট। গরু পাচারকারী সিন্ডিকেট থেকে ইউপি চেয়ারম্যান ও থানা পুলিশ পাচ্ছেন মাসোহারা। আবার অভিযোগ রয়েছে, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা গরু পারাপারে স্লিপ বাণিজ্য করে থাকেন। সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু পারাপার হলে একটি টোকেন নিতে হয়। আর এ টোকেট দেখালেই অতি সহজেই গরু চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
সীমান্তবর্তী লোকজন জানান, বিজিবি তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে সীমান্তের নিরাপত্তায় । কিন্তু দুই একজন চোরাচালানকারীর কারণে সীমান্তে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
বিজিবির ১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মোফাজ্জল হোসেন আকন্দ ও ৬১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হাসান শাহরিয়া মাহমুদ বলেন, বিজিবির প্রতিটি সদস্য সীমান্তের নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে। আমরা প্রায় প্রতিদিনে কোনো না কোনো এলাকায় সীমান্তবাসীকে সর্তক করছি। তারপরও দুই একজন সীমান্তে যাওয়ার চেষ্টা করছে ফলে এমন ঘটনা ঘটছে।
এএজেড