গরিবের ডা. খুরশিদ নেন না ফি, দেন জরুরি ওষুধও
ফেনীর পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের একজন চিকিৎসকের গড়ে তোলা রশিদ-আনোয়ারা মেমোরিয়াল দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রতি মঙ্গলবার বিনামূল্যে রোগী দেখার পাশাপাশি দেওয়া হয় জরুরি ওষুধ। গত ১১ মাসে সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ১ হাজার ২শ রোগী। গ্রামের ভেতর আধা পাকা নির্মিত একটি চিকিৎসাকেন্দ্রের সামনে জড়ো হয়েছেন প্রায় ৩০ জন রোগী। সেখানকার একটি কক্ষে এক এক করে রোগী দেখছেন চিকিৎসক। তাঁর কক্ষ থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বের হওয়ার সময় কারও হাতে নেবুলাইজার, কারও হাতে জরুরি কিছু ওষুধ তুলে দিচ্ছেন চিকিৎসা কেন্দ্রের কর্মচারীরা।
জরুরি ওষুধ নেবুলাইজারের মতো চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে একেবারেই বিনামূল্যে। রোগী দেখার বিপরীতে কোনো ফি-ও নিচ্ছেন না চিকিৎসক। এ চিত্র ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের রশিদ-আনোয়ারা মেমোরিয়াল দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রের। প্রায় এক বছর ধরে এভাবেই প্রতি সপ্তাহে বিনামূল্যে রোগী দেখা, জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ চলছে চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে। এটি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছেন ডা. খুরশিদ আলম।
সম্প্রতি রোগী দেখার ফাঁকেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তার জম্ম গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারে। তখন পল্লী চিকিৎসকদের ওপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল গ্রামের মানুষ। তাঁর মা অসুস্থতার সময় যথাযথ চিকিৎসা পাননি। তাঁর বাবা ও মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে চিকিৎসক হয়ে গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেবেন। সেই স্বপ্ন থেকেই ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগকে কাজে লাগান তিনি। সেখান থেকে এমবিবিএস শেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করেন।
২০১১ সালে যোগ দিন সরকারি চাকরিতে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই তাঁর মা-বাবার মৃত্যু হয়। অসুস্থ মা-বাবাকে যথাযথ চিকিৎসা নিতে না পারার আক্ষেপ থেকে গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র করার উদ্যোগ নেন তিনি। নিজেদের ২১ শতক জমির ওপর গড়ে তোলেন বাবা আবদুর রশিদ ও মা আনোয়ারা বেগমের নামে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র। ২০২২ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে রোগী দেখা।
খুরশিদ আলম জানান, প্রতি মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৪০-৫০ জন রোগী দেখেন, ব্যবস্থাপত্র দেন। গরিব ও অসহায় রোগীদের কিছু জরুরি ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। গরিব শ্বাসকষ্টের রোগীদের বিনামূল্যে নেবুলাইজারও দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে রয়েছে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও ব্লাড সুগার পরীক্ষার সুযোগ। প্রতিবছর একাধিক বার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে মেডিকেল ক্যাম্পও করা হয় চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে।
খুরশিদ আলম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে এ পর্যন্ত প্রায় ১১ মাসে ১ হাজার ২০০ জন রোগীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে। জটিল রোগী হলে প্রাথমিক সেবা দেওয়ার পর ফেনী জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। চিকিৎসক খুরশিদ আলম বর্তমানে ফেনী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত। কর্মস্থল তাঁর বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে হওয়ায় চিকিৎসা কেন্দ্রে সময় দেয়া তার জন্য সহজ হয়েছে। পাশাপাশি ফেনী শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখেন।
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, রশিদ-আনোয়ারা মেমোরিয়াল দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রটি অবস্থিত ফেনী শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। চিকিৎসক খুরশিদ আলমের বাড়ির পাশে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। চিকিৎসক উপস্থিত হওয়ার আগেই চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে নানা বয়সী রোগীদের ভিড়। চিকিৎসা কেন্দ্রের একজন কর্মচারী রোগীদের নাম রেজিস্টারে লিখে প্রত্যেককে সিরিয়াল নম্বর দিচ্ছেন। এরই মধ্যে বিকেল চারটার আগেই চিকিৎসক এসে হাজির। রোগী দেখা শুরু করেন তিনি। চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে স্বাস্থ্যসেবা দিতে খুরশিদ আলমের সঙ্গে এক নারী কর্মীসহ দুজন কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন।
চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনেই কথা হয় স্থানীয় কাশিমপুর গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ রুপধন বিবি (৮০) এর সঙ্গে। তিনি জানান, সারা শরীরে বাথ্যা সহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগের চিকিৎসা নিতে তিনি এসেছিলেন। চিকিৎসক তাকে ব্যবস্থাপত্রের পাশাপাশি কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনামূল্যে দিয়েছেন। এর আগেও অনেকবার চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।
নুর নাহার (৩৫) নামের স্থানীয় একজন নারী বলেন, টাকা দিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তাঁরা নেই। তাই বেশির ভাগ সময় এ চিকিৎসা কেন্দ্রেই তিনি চিকিৎসা নেন। খুবই আন্তরিকতা নিয়ে চিকিৎসক রোগী দেখেন।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহজালাল ভূঞা বলেন, চিকিৎসা কেন্দ্রটি করার পর থেকে নিজ গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গরিব ও অসহায় রোগীরা বেশ ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। সপ্তাহে এক দিনের পরিবর্তে সময় বাড়ানো গেলে গরিব রোগীরা আরও উপকৃত হতো। সমাজসেবক আবু তাহের বলেন, গরিবের ডা. হিসেবে খুরশিদ আলমের নাম ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি ফি নেন না, জরুরি ওষুধও দেন। তার মতো অন্য ডাক্তাররা এগিয়ে এলে গরিব ও অসহায় রোগীরা পবে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা।
এএজেড