তীব্র শীতে রামেকে বাড়ছে দগ্ধ রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে আগুনে পোড়া রোগীর আর্তনাত বাড়ছে। শীতের তীব্রতায় আগুনের সংস্পর্শে এসে শরীরে উষ্ণতা ছড়াতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। কেউ আবার গরম পানিতে গোসল করতে গিয়ে ঝঁলসে যাচ্ছে। এভাবেই অসাবধানতার ফলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিদিন রামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হচ্ছে রোগী। শীত মৌসুমে বেড়েছে রোগীও। ভর্তি রোগীদের একটি বড় অংশ গভীর পোড়া নিয়ে আসছেন। যাদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা বলছেন, শীত আসলেই পোড়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। এবার সংখ্যাটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। যে রোগীগুলো আসছে তাদের অধিকাংশই একটু সচেতন হলে দুর্ঘটনা এড়াতে পারত। আবার দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালে না এসে বাইরে হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার ফলে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি আরও বেড়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জন্য বরাদ্দ ৫০টি শয্যার বিপরীতে ২৪টি ব্যবহার করা হচ্ছে। সবগুলো বেডেই রোগী আছে। তবে এর আগের দিন শনিবার এই ইউনিটে ৪০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই ইউনিটে একটু পরপর রোগীর চিৎকার আর আর্তনাত ভেসে আসছে। কখনো পরিবারের প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে স্বজনদের আহাজারিও প্রায় ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সূর্যরিকণ এলাকার বাসিন্দা মোসা. বেগমের (৬০) নাতনী মিরিআরা খাতুন জানান, তার নানী গৃহিনী। প্রতিদিনের মতো কাজ শেষে আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়ে গেছে। গত ৪ জানুয়ারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। মুখসহ কোমরের নিচে সবকিছু পুড়ে গেছে।
আরেকজন রোগী শিশু আল আমিন। তার বয়স মাত্র ২ বছর। তাদের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর। বাবা কৃষি কাজের পাশাপাশি শীত মৌসুমে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করেন। গুড় তৈরির সময় গরম রস পড়ে আল আমিনের দুই হাত ও দুই পা পুড়ে গেছে বলে জানা গেছে।
আল আমিনের বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, সকালের দিকে গরম চুলায় ছেলের মা রস জাল দিচ্ছিল। ছেলে পাশে খেলাধুলা করছিল। হঠাৎ গরম রসে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার শরীরের প্রায় ১৪ শতাংশ পুড়ে গেছে।
এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. আফরোজা নাজনীন বলেন, শীত মৌসুমে অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। এ কারণে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গত ১৫ দিনে প্রচুর রোগী ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালেই মারা গেছে ৫ জন। যারা সবাই আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়ে যায়।
ডা. আফরোজা নাজনীন জানান, গত নভেম্বর মাসে হাসপাতালে পোড়া রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭৯ জন। এর মধ্যে দুইজন হাসপাতালে মারা গেছে। ডিসেম্বরে ১১৪ জন পোড়া রোগীর মধ্যে ৪ জন মারা গেছে। এ ছাড়াও জানুয়ারি মাসের গত ১৫ দিনে ৫৬ জন পোড়া রোগী ভর্তি হয়েছে।
রোগীদের অসাবধানতার কারণে অধিকাংশ রোগী অগ্নিদগ্ধ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাসপাতালের মৃত্যু সংখ্যাটা প্রকৃত মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরে না। কারণ হাসপাতালে ৩০ শতাংশ বা এর বেশি বার্নের রোগী আসলে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক রোগীকে ঢাকায় রেফার্ড করতে হয়। অনেক রোগীর স্বজন বুঝেই যান, তার রোগী বাঁচবে না। তখন বাসায় নিয়ে চলে যায়। আবার ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথেও অনেক রোগী মারা যায়। এ ছাড়াও ঢাকায় যে সকল রোগী রেফার্ড করা হয় সেখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার হার নেহাতই কম। তাই সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই। শীতকালে পোড়া রোগী ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু একটু সচেতন হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো যেতে পারে। বিশেষ করে গরম পানি হাঁড়িতে না বহন করে বালতিতে বহন করলে দগ্ধ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা যায় গ্রামে। আগুন পোহানো ও শিশুদের চড়ুইভাতিতে আগুন জ্বালিয়ে রান্না করতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি পরিবারিক নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। গরম পানি, চা, রস বা চুলার কাছে কোনোভাবে শিশুদের না নেওয়ার পরামর্শও দেন এই চিকিৎসক।
এ ব্যাপারে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, শীতের সময়ে বার্নে রোগী বেড়ে যায়। তখন চিকিৎসা দিতে বেশ বেগ পেতে হয়। তবে বার্ন ইউনিটের দোতলা ভবনকে চারতলা করা হবে। টাকাও বরাদ্দ হয়েছে। চারতলা হয়ে গেলে সেখানেই ওটি এবং আইসিইউ হবে। আর চিকিৎসক ও লোকবল সংকট তো আমাদের আছেই। সেটা মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। তবে সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
এসআইএইচ