দিনরাত ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়
লক্ষ্মীপুরে দিনরাত শ্রমিক দিয়ে কাটা হচ্ছে ফসলি জমির মাটি। আর এই মাটি প্রায় ২০০ পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকে করে সরবরাহ হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার বাংগা খা ইউনিয়নের (৩ নম্বর ওয়ার্ডস্থ) মাইচ্চার মাঠ নামক স্থানে কৃষকদের বিশাল ফসলি জমিতে প্রতিদিন এই অবৈধ কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে স্থানায় প্রভাবশালী একটি চক্র। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জমির মালিকদের বিভিন্ন প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে মাটি কেটে নিচ্ছেন তারা। এতে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বর্গাদার কৃষকরা। অপরদিকে ট্রাকে করে মাটি নেয়ায় নষ্ট হচ্ছে রাস্তাঘাট, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্থানীয়দের।
এদিকে এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারী) সন্ধ্যায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ ভাবে ফসলি জমি থেকে ইটভাটায় মাটি সরবাহের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৯ জনকে আটক করেন সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মখবুল হোসেন। তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে আটককৃতদের ১৮ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং ফসলি জমির মাটি না কাটার শর্তে মুচলেকার মাধ্যমে ছেড়ে দেন তিনি। কিন্তু ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যায় মূল হোতা প্রভাবশালীরা। তবে প্রশাসনের এই অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরদিন বুধবার (৪ জানুয়ারী) সকাল থেকে পুনরায় শুরু করা হয় ফসলি জমি থেকে ইটভাটায় মাটি সরবরাহের কার্যক্রম। এতে স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অবৈধ ভাবে ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি কার্যক্রমের মূল পরিচালনায় রয়েছে ১২/১৩ জন স্থানীয় প্রভাবশালী। এরা হচ্ছেন- শেখ জামান স্বপন ও তার শেয়ার পার্টনার মো. ফারুক। শেখ জামান স্বপন বাংগাখাঁ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। এ ছাড়াও রয়েছে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রুবেল ও তার ভাই রবিন, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহাগ ও তার শেয়ার পার্টনার রহিম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিহাদ, সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফরহাদুল ইসলাম ওরপে সৈনিক ফরহাদ, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বাসার, স্থানীয় আদিলপুর এলাকার ফরহাদ, আলমগীর হোসেন, ইউসুফ, শিপন, কিরণ, শওকত, সুমন, রাপু ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহজাহান মেম্বার। প্রভাবশালীরা কিছু সংখ্যক ফসলি জমির মালিকদের লোভে ফেলে জমির মাটি কিনে নেয়। এতে আশপাশের জমি নষ্ট হয়ে পড়ায় তারাও বাধ্য হয়ে নিজেদের জমির মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রভাবশালীদের ভয়ে স্থানীয় কেউই প্রতিবাদ করতে পারে না। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের।
সরেজমিনে বাংগাখাঁ ইউনিয়নের মাইচ্ছার মাঠ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার পাশে একটি মাঠেই প্রায় ১৩৫ কানি ফসলি জমি। শ্রমিক দিয়ে এসব জমি থেকে মাটি কেটে একের পর এক পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। দূর থেকে মনে হবে ফসলি মাঠে পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকের বিশাল মেলা বসেছে। রাতেও এই মাঠে আলো জালিয়ে চলে মাটি কাটা ও ইটভাটায় সরবরাহের কাজ। একই ভাবে রাস্তার উল্টো পাশের ফসলি জমিগুলোতেও চলছে মাটি কাটা ও ইটভাটায় সররাহের কার্যক্রম।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আরও জানান, মাইচ্ছার মাঠের ১৩৫ কানি ফসলি জমির মধ্যে স্থানীয় হারুনুর রশিদের ৯ শতাংশ জমির মাটি, বকুল কাজীর ৩০ শতাংশ, আনার উল্যার ৪২ শতাংশ, হাফিজ উল্যার ৪২ শতাংশ, আলমগীর কাজীর ৬০ শতাংশ ও মো. হেলালের ১৮ শতাংশ ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করছেন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিহাদ। স্থানীয় মুরি ব্যবসায়ী সর্দারের ৩৩ শতাংশ ও আবুল কাশেমের ৩০ শতাংশ জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করছেন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সোহাগ ও তার শেয়ার পার্টনার রহিম, স্থানীয় নুরুল আমিনের মালিকাধীন ৬৬ শতাংশ জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করছেন সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা ফরহাদুল ইসলাম ওরপে সৈনিক ফরহাদ। এ ছাড়াও ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন স্পট থেকে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবৈধ ভাবে ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করছে এসব প্রভাবশালী চক্র।
স্থানীয় শামছুল ইসলাম, নুরুল আলমসহ কৃষকরা জানান, মাইচ্ছার মাঠের ফসলি জমিগুলোর মালিকদের মধ্যে অনেকেই কৃষকদের দিয়ে বর্গা চাষাবাদ করে থাকেন। তাই মাটি দস্যুদের টাকার লোভে পড়ে তারা জমির টপ সয়েল বিক্রি করে দিচ্ছে। অন্যদিকে পাশের জমির মাটি কাটায় নিচু হওয়ায় সেচের পানি না পাওয়ার ভয়ে বাধ্য হয়ে নিজের জমির মাটিও বিক্রি করছে অনেকে। এতে সর্বনিম্ন ৬ শতাংশ জমি থেকে মাটি কাটার কোদালের দুই কোপ পরিমাণ মাটি ৩০/৩২ হাজার টাকা হারে পাচ্ছে জমির মালিকরা। এতে জমির মালিকরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বর্গা চাষিরা। অপরদিকে জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়ায় হুমকিতে পড়বে ফসলের উৎপাদন।
আরেক কৃষক নুরুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ৫ গণ্ডা জমির চারপাশের জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এতে আমার জমি উচু হয়ে পড়ায় সেচ দিতে পারছি না। বাধ্য হয়ে নিজে মেশিন বসিয়ে ফসলি জমিতে পানি দিতে হচ্ছে। এতে আমার অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে। যেখানে সেচের পানি ২০০/৩০০ টাকায় পেতাম। এখন তার খরচ পড়ছে ৮০০/১০০০ টাকা। ইটভাটায় মাটি বিক্রেতাদের হাত থেকে ফসলি জমি ও কৃষকদের ভাগ্য রক্ষায় প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এদিকে স্থানীয় আবদুল আলিম, কলেজছাত্র সাহেদুল ও রিকশাচালক রহমান বলেন, পাকা রাস্তা দিয়ে এসব পিকআপ ভ্যান ও ট্রাক ঘন ঘন যাতায়াতের ফলে নষ্ট হচ্ছে রাস্তাসহ আশপাশের বাড়িঘর। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, হুমকিতে পড়ছে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা। তাই দ্রুত প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।
প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা আমান্য করে ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংগাখা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ জামান স্বপন, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিহাদ ও যুগ্ম আহ্বায়ক সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মাটি বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে অভিযুক্ত মাটি বিক্রেতা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক রুবেল বলেন, আমি মাত্র তিনটি স্পট থেকে ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করি। আমার থেকে আরো বড় বড় ৮/১০ জন প্রভাবশালীরা আছে। তারা বিভিন্ন স্পট থেকে মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে আসছে। তাদের বন্ধ করেন, তাহলে আমিও বন্ধ করে দিবে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফরহাদুল ইসলাম সৈনিক ফরহাদ। তিনি বলেন, আমার ৪টি পিকআপ ভ্যান আছে। মাটি বিক্রিতাদের কাছে ভাড়া দিয়েছি। তারা আমাকে গাড়ি ভাড়ার টাকা দেয়। আমি মাটি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। আমার বিরুদ্ধে অপ্রপ্রচার করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. জাকির হোসেন বলেন, ফসলি জমির উপরিভাগের যে মাটি (টপ সয়েল) ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে। এটা কৃষি উৎপাদনের জন্য খুবই ক্ষতিকর। জমির সকল রাসায়নিক তথা উৎপাদনের সকল প্রক্রিয়া থাকে টপ সয়েলে, যা থেকে উদ্ভিদ খাদ্য গ্রহণ করে। জমির এই টপ সয়েল তৈরি হতে ২০-৫০ বছর সময় লেগে যায়। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করা হচ্ছে। তবে ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসন দিকে দৃষ্টিপাত করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, যেখানে সরকার ইঞ্চি পরিমাণ জমি অনাবাদি রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন সেখানে ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে কৃষি উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এ ঘটনায় ৯ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। তবে মূল হোতাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসআইএইচ