জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে তরুণ রায়ের পাঠাগার
ছোটবেলা থেকে জ্ঞানপিপাসু মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তরুণ রায়ের। ২০০৩ সালে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে বসত ভিটার দুই শতক জমি দান করে গড়ে তোলেন ‘তরুণের অভিযান পাঠাগার’। বর্তমানে পাঠাগারটি আলো ছড়াচ্ছে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলাসহ ও পাশ্ববর্তী লালমনিরহাট জেলার মানুষের মাঝে।
বইপ্রেমী এই যুবকের পুরো নাম বিকাশ চন্দ্র রায় তরুণ। তার বয়স ৩৭ বছর। এর মধ্যে পাঠাগারটি গঠনের পর পার হয়েছে ১৮ বছর।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের বৈদ্যের বাজার পল্লীর মৃত বীরেন্দ্র নাথ রায়ের ছেলে তরুণ। বর্তমানে চিত্রকর্ম ও প্রেস ব্যবসায় নিয়োজিত। শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও নিজ বাড়িতে গ্রামের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীসহ সব বয়সী মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বইয়ের সম্ভার গড়ে সকলের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার পাঠাগারে বঙ্গবন্ধুর জীবনীসহ বিভিন্ন ধরনের বই ও দৈনিক পত্রিকা হাতে পাচ্ছেন পাঠকরা। বর্তমানে তার পাঠাগারে বই রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন পাঠক বই ও পত্রিকা পড়তে আসেন পাঠাগারে।
তরুণের পাঠাগারে অধিকাংশ পাঠক বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বই পড়ার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণ রায়। এছাড়া বাড়ি থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে রাজারহাট উপজেলা সদরের ৩টি সেলুনে গড়ে তুলেছেন ভলান্টিয়ার’স লাইব্রেরি। এসব সেলুনে গড়ে দিয়েছেন বুক সেলফ। ৭ মাস ধরে নিয়মিত বই সরবরাহ করছেন এসব ভলান্টিয়ার’স লাইব্রেরিতে। সেলুনে চুল দাঁড়ি কাটতে আসা লোকজন তাদের অপেক্ষার সময় কাটাচ্ছেন বই পড়ে।
বৈদ্যের বাজার এলাকার কলেজ শিক্ষার্থী বৃষ্টি রায় ও বিথী রানী রায় বলেন, ‘আমাদের গ্রামে এমন একটি পাঠাগার গড়ে উঠবে ভাবতে পারিনি। আমরা পড়াশুনার পাশাপাশি প্রতিদিন পাঠাগাড়ে গিয়ে পছন্দের বই পড়ি। এখনে বই পড়ে খুব ভালো লাগে। করোনা মহামারীকালে পাঠাগার বন্ধ থাকলেও পাঠাগারের উদ্যোক্তা তরুণ রায়কে ফোন করলেই তিনি পছন্দের বই সরবরাহ করতেন। তার বই পড়ার অভিযান, গ্রামের শিক্ষিত মানুষকে জ্ঞান চর্চায় বেগবান করছে।’
ওই এলাকার আশরাফুল ইসলাম ও পংকজ কান্তি রায় বলেন, তরুণের অভিযান পাঠাগারের উদ্যোক্তা বিকাশ চন্দ্র রায় নিজের অর্থায়নে বই পড়ার অভিযানকে বেগবান করেছেন। এটা সত্যিই বিরল। তিনি কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ১৮ বছর ধরে পাঠকের চাহিদা পুরণ করে আসছেন। এতে যে শুধু আমাদের গ্রামের মানুষ উপকৃত হচ্ছে তা নয়, আশেপাশের অনেক মানুষ তরুণের অভিযান পাঠাগার থেকে জ্ঞান অর্জন করছেন।’
রাজারহাট উপজেলা সদরের স্বপ্ন হেয়ার ড্রেসারের মালিক সুধাংশু চন্দ্র শীল বলেন, ‘তার সেলুনে ভলান্টিয়ার’স লাইব্রেরি হওয়ায় আমিসহ গ্রাহকরা খুব উপকৃত হয়েছেন। আগে আমার সেলুনে গ্রাহকরা সিগারেট খেয়ে অপেক্ষার সময় কাটাতেন। এখন তারা সেলুনে বই পড়ে সময় কাটান। আমার সেলুনের ভলান্টিয়ার’স লাইব্রেরি থেকে অনেক গ্রাহক পছন্দের বই বাড়িতে নিয়ে পড়ে আবার ফেরত দেন। তরুণের অভিযান পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা তরুণ দাদাকে ফোন দিলে তিনি চাহিদামতো বই আমার সেলুনে সরবরাহ করেন।’
তরুণের অভিযান পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা বিকাশ চন্দ্র রায় তরুণ বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল বাড়িতে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার। ঈশ্বরের কৃপায় পাঠাগারের নামে দুই শতাংশ জমি দান করে আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি। টানা ১৮ বছর ধরে এলাকার মানুষজন পাঠাগারে এসে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হচ্ছে। যারা পাঠাগারে আসতে পারেন না এমন পাঠক যেন বই পড়া থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য তাদের চাহিদা অনুযায়ী পছন্দের বই বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি। এছাড়া উপজেলা সদরের ৩টি সেলুনে গড়ে তোলা ভলান্টিয়ার’স লাইব্রেরিগুলোর খোঁজখবর রাখছি নিয়মিত। চাহিদামতো এসব ভলান্টিয়ার’স লাইব্রেরিতে বই সরবরাহ করছি। নিজে সবসময় বই পড়ি এবং পাঠকদের বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করি। বই পড়ার মাধ্যমেই আলোকিত সমাজ গঠন করা সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তাই নিজের আয়ের একটি অংশ পাঠাগারের জন্য ব্যয় করি।’
তরুণ জানান, অর্থাভাবে পাঠাগারের ভবন নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে। সরকারি অনুদান ও সহযোগিতা পেলে পাঠাগারের এক তলা ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা সহজ হবে। তাই এই পাঠাগারটিকে একটি আধুনিক পাঠাগার হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক নিগমানন্দ রায় জানান, তরুণের অভিযান পাঠাগারটি দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে পাঠকের চাহিদা পূরণ করে আসছে। এখন দিন দিন পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজও থেমে রয়েছে। পাঠাগারটিকে মডেল পাঠাগার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সকলের সহযোগিতা চান তিনি।
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নূরে তাসনিম বলেন, ‘তরুণের অভিযান পাঠাগারে আমি নিজেও গিয়েছি। নিজের অর্থায়নে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে গ্রামের মানুষদের বই পড়ার আগ্রহকে বেগবান করার পাশাপাশি ১৮বছর ধরে পাঠকের চাহিদা পূরণ করে আসছেন তরুণ রায়। যা সত্যিই বিরল। পাঠাগারের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে কিছু অনুদান দিয়েছি। সামনে কোনো বরাদ্দ এলে আবারও দেওয়া হবে।’
/এএন