একসঙ্গে কুমিল্লার ৬ শিক্ষার্থী নিখোঁজ
‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা’ মাথায় রেখে চলছে তদন্ত
কুমিল্লা থেকে একসঙ্গে নিখোঁজ হওয়া ৬ শিক্ষার্থী কেন ঘর ছেড়েছেন এ ব্যাাপারে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। তবে জঙ্গীবাদের বিষয়টি মাথায় রেখেই চলছে তদন্ত, খোঁজা হচ্ছে নিখোঁজদের অবস্থান। কিন্তু এরই মধ্যে ১৮দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও নিখোঁজদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নিখোঁজদের সন্ধানে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। তাদের খুঁজে পাওয়া কিংবা অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না। তাদের সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে। অপরদিকে সন্তানদের খোঁজে প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ছুটে যাচ্ছেন অভিভাবকরা, দিচ্ছেন তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর, সহায়তা করছেন তদন্ত কাজে। কিন্তু ঘরে ফিরছে না তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তান।
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কাছাকাছি সময়ে কুমিল্লার যে ছয় কলেজ শিক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছে, তাদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছেন। যারা নিখোঁজ রয়েছেন তারা একই কারণে কিংবা কি কারণে ঘর ছেড়েছে তা জানতে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে সকল তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করছেন তারা এসব শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং সামাজিক যোগাযোগ সম্পর্ক। পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর চলমান তদন্ত প্রক্রিয়া সমন্বয়ের মাধ্যমে চলছে বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা জেলার পুলিশ প্রধান। জেলা পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে না আসা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না তারা কেন ঘর ছেড়েছে।’
তাদের নিখোঁজের বিষয়ে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘কোনো ভাসমান তথ্যের উপর নির্ভর করে কিছু বলতে চাই না। তদন্ত চলছে। ’
গত ২৩ আগস্ট থেকে নিখোঁজ হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া ও সরকারি কলেজের ৬ শিক্ষার্থীসহ সাতজন। এরপর বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রত্যেকের পরিবারই সন্ধান চেয়ে থানায় জিডি করেছেন। কিন্তু এরই মধ্যে ১৮ দিন অতিবাহিত হলেও তারা আর বাসায় ফিরেননি, মেলেনি তাদের কোনো হদিস। নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চারজন চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং বাকি দুজন অনার্স প্রথম ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন-কুমিল্লা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও নগরীর রাণীর বাজার এলাকার মো. সাইফুল ইসলামের পুত্র নিহাল (১৭), একই এলাকার শাহাব উদ্দিনের ছেলে হাসিবুল ইসলাম (১৮), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী কান্দিরপাড় এলাকার মাহবুবুর রহমানের পুত্র সামি (১৭), নগরীর রেইসকোর্স এলাকার মুজিবুর রহমানের (মুকুল) পুত্র ইমরান বিন রহমান (শিথিল), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ও নগরীর রেইসকোর্স এলাকার মো. ফয়েজ আহমেদের ছেলে ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯) এবং অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও নগরীর ঝাউতলা এলাকার নুরুল ইসলামের পুত্র মো. আমিনুল ইসলাম (২৩)।
এই ছয়জন ছাড়াও ঢাকার ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে অনার্স সম্পন্ন করা নিলয় নামে এক শিক্ষার্থীও রয়েছেন নিখোঁজদের তালিকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের বিষয়ে গত বুধবার কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা বৈঠক করেছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা। এদিন বিকালে কুমিল্লা র্যাব কার্যালয়ে আরেকটি বৈঠক করেন নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের অভিভাকরা। এ সময় তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার, কম্পিউটার, ল্যাপটপ সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য দিয়েছেন অভিভাবকরা। পুলিশ সুপারের কার্যালয় ছাড়াও কুমিল্লা র্যাব কার্যালয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে আরো অন্তত ৫/৬ বার বৈঠক হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এ ছাড়াও শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইউনিটের তিনজনের একটি দল নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের বিভিন্নজনের বাসায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অভিভাবক ও স্বজনদের কাছে জানতে চেয়েছেন তাদের লাইফস্টাইল, কি ধরনের ধর্মীয় বই পড়ত কিংবা তাদের আচরণ সম্পর্কে। পরদিন ঢাকা থেকে এডিসি পদমর্যাদার একজন একজন ডিবি কর্মকর্তাও ফোন করে নিখোঁজদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কুমিল্লার পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান বলেন, ‘নিখোঁজদের খোঁজে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। কুমিল্লা থেকে সকল তথ্য উপাত্ত বিশেষজ্ঞ দলকে দেওয়া হচ্ছে।’
র্যাব-১১, সিপিসি-২ এর উপ পরিচালক ও কোম্পানী অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, ‘অভিভাবকরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। আমরা গত কয়েকদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে খুবই তৎপর। তবে এখনই তারা কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলতে চাইছি না। সব বিষয়ে তদন্ত করেই আমরা এগুচ্ছি। তাদের খুঁজে বের করতে সারা দেশে র্যাবের কয়েকটি টিম কাজ করছে।’
এ প্রসঙ্গে নিখোঁজ ইমরান বিন রহমানের পিতা মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘তাদের জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আবার উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ভয়, তারা যেনো জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে। আমার শঙ্কার বিষয়টি আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে তুলে ধরেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের কথাই যদি বলি, তাহলে ধারণা করছি সে ভিন্ন ট্র্যাকে চলে গেছে। সে ধার্মিক, সরল এবং মানুষকে বিশ্বাস করে। তাকে ডাইভার্ট করা সম্ভব। সে নিশ্চয়ই ফাঁদে পড়েছে। আমার ছেলে আগে কখনো একদিনের জন্যও ঘরের বাইরে ছিল না। কখনো মিথ্যা বলত না। কিন্তু এবার সে মিথ্যা বলেছে, অর্থাৎ তার চিন্তা সৎ ছিল না।’
মুজিবুর রহমান আরও বলেন, ‘আমার ছেলে যদি অপরাধী হয়ে থাকে তাহলে তাকে পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হোক, শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু আমি তার অবস্থান জানতে চাই, তাকে ফেরত চাই।’
নিখোঁজ শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদের বাবা ফয়েজ আহমেদ বলেন, আমার ছেলেটা খুব শান্ত স্বভাবের ছিল। বাসার পাশেই আমার মুদি দোকান, প্রায়ই সেখানে বসত। রাতে তার মামার সঙ্গে ঘুমাত। তার মামাকেও কিছু বলে যায়নি। শেষদিন বের হওয়ার সময় বলেছিল দ্রুতই ফিরে আসবে। রাত ১২টায় ফেরেনি দেখে আমি কল দিলাম, তখন নম্বর বন্ধ পাই। দুই দিন পর ২৬ আগস্ট থানায় জিডি করি। এখনও ছেলেটা ফেরেনি।
এসআইএইচ