'বাবারে দৌড়াই লাডি দি মারি হালাইছে কোম্পানির হোলায়ে'
আমার আকাশেরও চাঁদ কেড়ে নিলো রে, আমার বাবারে দৌড়াই আনি লাডি দি বাড়ি দি মারি হালাইছে কোম্পানির হোলায়ে- মৃত ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে এমন আহাজারি সৌদি আরবে নিহত প্রবাসী যুবক আবদুর রহমানের মায়ের। স্বজনদের দাবী হত্যার করে রাস্তায় পেলে রাখা হয় প্রবাসীকে। ঘটনার চার মাস পরও মরদেহ ফেরত না পাওয়ায় নিহতের লক্ষীপুরের গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। এদিকে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ও ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে অতলে ভাসছেন স্বজনরা।
আজ শুক্রবার (০৯ সেপ্টেম্বর) সরজমিনে গেল নিহত প্রবাসীর আবদুর রহিমের গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের শোকে আত্মনাদে ভারি হয়ে উঠে আকাশ। গত পহেলা মে (রবিবার) সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের নিকটতম আল হারমোলিয়াহ এলাকার একটি ছাগলের খামার থেকে বাংলাদেশী ওই যুবকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে সৌদি পুলিশ। এ ঘটনায় এক সৌদি নাগরিক ও একজন সুদানি নাগরিককে আটক করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে বলে জানা যায়।
এদিকে এ ঘটনায় বিচারের দাবীতে সম্প্রতি ভুক্তভোগীর পরিবার লক্ষীপুর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে দ্রুত লাশ দেশে ফেরত আনার আশ্বাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। নিহত প্রবাসী আবদুর রহমান লক্ষীপুরের কমলনগর উপজেলার উত্তর চরলরেঞ্চ গ্রামের মো. হানিফের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট।
এছাড়াও তার দুই জন ছোট বোন রয়েছে। দো-চালা একটি টিনসেট ঘরে থাকেন পরিবারের সবাই। বড় ভাই আবুল কাশেম সিএনজি চালিয়ে নিজের পরিবারেরই খরচ যোগান দিতে হিমশিম খায়। তাই প্রবাসী ছোট ভাই রহমানের উপার্জনেই চলতো পুরো সংসার।
স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় তোরাবগঞ্জ বাজারে পানের ব্যবসা করতেন রহমান। অভাব-অনটন দূর করতে ২০১৯ সালের ধার-দেনা করে স্থানীয় মামুন নামে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ভালো চাকুরীর আশায় সৌদি আরব জান আবদুর রহমান। কিন্ত সৌদি যাওয়ার পর জানতে পারে তার চাকুরী মরুভূমিতে উট চরানো।
এ কাজ করা তারপক্ষে মোটেও সম্ভব ছিল না। তার সাথে প্রতারণা করেছে মামুন। তবুও বহু কষ্টে তিনি ২ বছর কাটিয়েছেন। করোনার সময়ও তার কোন ছুটি ছিল না। এর মাঝে কারণে অকারণে মালিকপক্ষ তাকে মারধর করতো। পরে অতি নির্যাতনে সেখান থেকে একদিন তিনি পালিয়ে অন্যত্র চলে যান। যুক্ত হন নতুন আরেকটি কাজে। কিন্ত এখানে গিয়েও সে জানতে পারে তার কাজ মরুভূমিতে ছাগলের খামারের শ্রমিক। নতুন কর্মক্ষেত্রে সুদানি সহকর্মীদের সাথে তার প্রায় ঝগড়া হতো।
পরে ১লা মে (রবিবার) রক্তাক্ত অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। নিহতের তিনদিন পর সৌদিতে অবস্থানরত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে প্রবাসী রহমানের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ছেলেকে হারিয়ে এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখেছে বাবা-মা।
নিহতের মা লাকী বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, সৌদি আরবে ঈদের আগের দিন বিকেল বেলায় ছেলের সাথে তার শেষ কথা হচ্ছিল। কথা বলার এক ফাঁকে হঠাৎ করে আবদুর রহমান চিৎকার দিয়ে বলে উঠে 'মা আজরাইল আসে' (কোম্পানি ছেলে)। এ কথা বলেই ফোন কেটে রেখে দেয়।
এরপর এদিক থেকে বারবার ফোন দিয়েও আর তাকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বাড়ি থেকে পর পর দুদিন তার ফোনে যোগাযোগ করে যখন কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। বিদেশে অবস্থানরত স্বজনদের বরাত দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানায়, সুদানি কোন এক সহকর্মী এবং মালিকের এক আত্মীয় প্রবাসী রহমান কে খুন করে গাড়ি চাপায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে মিথ্যা প্রচার করে। তখন ঘটনাটি মেয়ের জামাই সৌদি প্রবাসী মোঃ ইউছুপকে জানানো হলে, ইউছুপ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আবদুর রহমানকে খুন করা হয়েছে।
পরে তিনি সেখানকার স্থানীয় হাসপাতালের মর্গে গিয়ে আবদুর রহমানের লাশ দেখে আসে। এ ঘটনায় হত্যাকারীদের বিচারের দাবী জানিয়েছেন নিহতের মা-বাবসহ পরিবারের সদস্যরা।
এদিকে ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত পূর্বক হত্যাকারীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবী জানিয়ে কমলনগর উপজেলার চর লরেঞ্চ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান একেএম নুরুল আমিন মাষ্টার বলেন, প্রবাসী আবদুর রহমানের পরিবার অতি দরিদ্র। ধার-দেনা করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। নিহতের মরদেহ দ্রুত পরিবারের নিকট ফেরত দেয়াসহ অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে প্রশানের প্রতি সু-দৃষ্টি কামনা করেন।
কমলনগর থানার অফিসার্স ইনচার্জ মোহাম্মদ সোলাইমান জানান, এ বিষয়ে প্রবাসীর পরিবার থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন। তবে কেউ থানায় জানায় নি। লিখিত পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামান জানান, বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সাথে ফোনালাপ হয়েছে। লাশ দেশে আনার বিষয়ে আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারকে সবধরণের সহায়তা করার চেষ্টা করবো। তবে হত্যা না আত্মহত্যা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান তিনি।
এএজেড