ইউটিউব দেখে মাল্টা চাষে স্বাবলম্বী মুক্তার
‘সারি-সারি মাটির উচু লেন, তার উপরেই সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে মাল্টা গাছ। ভরপুর মাল্টায় নুয়ে পড়ছে ডালপালা। সবুজ অরণ্যে পাতার ফাঁকে ফাঁকে উকি দিচ্ছে লেবু জাতীয় এই রসাত্বক ফল ‘মাল্টা’। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর চরলক্ষ্মী ইউনিয়নের হাজিমারা গ্রামে সাড়ে ৮ একর জমির উপরে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে এমনই একটা মাল্টা বাগান। বর্তমানে এই বাগানে ১৫০০টি মাল্টা ফলের গাছ রয়েছে। উৎপাদিত মাল্টা বাজারজাত করে প্রতি বছর সাফল্য দেখছেন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা রেজাউল করিম মুক্তার। তিনি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়ীর মাথা নামক এলাকার বাসিন্দা।
‘ইউটিউব’ দেখে এই বিশাল মাল্টা বাগান গড়ে তুলেন করিম মুক্তার। এজন্য তিনি ৮০ লাখ টাকা পারিবারিকভাবে মূলধনও পান। তার এ বাগানকে ঘিরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে ১০/১২ জন বেকার মানুষের। মুক্তারের সাফল্য দেখে দিন দিন মাল্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে বেকার যুবকরাও।
এদিকে লক্ষ্মীপুরের মতো প্রত্যেন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষণহীন এক যুবকের কৃষিতে এমন সাহসিক সাফল্য দেখে অভিভূত খোদ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। মাল্টার ফলন বৃদ্ধিতে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ।
জানা যায়, ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উর্ত্তীণের পর কিছু দিন বেকার অবস্থায় ঘোরাঘুরি করেন রেজাউল করিম মুক্তার। প্রবাসী আপন বড় ভাই আজিম ভূঁইয়ার উৎসাহ উদ্দীপনায় ঝুঁকে পড়েন মাল্টা চাষে। ৫ বছর পূর্বে আত্মীয়দের কাছ থেকে সাড়ে ৮ একর জমিতে ১০ বছরের চুক্তিতে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ভাড়া নেন তিনি। এরপর ইউটিউব দেখে মাল্টা চাষের উপযোগী করে তুলতে তৈরি করেন সমতল থেকে উচু উচু মাটির লেন। যা বর্ষায় মৌসুমেও পানিমুক্ত রাখবে মাল্টা গাছকে। প্রথমবার ৩ হাজার চারা লাগান ওই বাগানে। কিন্তু কোনও কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ সবগুলো মাল্টা গাছ মারা যায়। এতে সার ও কিটনাশকসহ প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হন তিনি। তবে এই লোকশানে তিনি একটুও ভেঙে পড়েননি। পারিবারিক উৎসাহ ও নিজের আত্মবিশ্বাস থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নেমে পড়েন। সাফল্যের কথা মাথায় রেখে পুনরায় রাজশাহী থেকে এক বছর বয়সী মাল্টার কলফ চারা এনে রোপন করেন তিনি। সার ও কিটনাশক প্রয়োগসহ নিয়মিত স্বেচ্ছ ও আগাছা পরিচর্যায় বাগানেই ব্যস্ত থাকেন তিনি এবং মজুরি ভিত্তিক নিয়োগকৃত শ্রমিকরা।
আলাপকালে শ্রমিকরা জানায়, মুক্তারের মাল্টা বাগানের কারণে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বর্তমানে বাগানে ‘বারি মাল্টা-১’ জাতের প্রায় ১৫০০ মাল্টার গাছ রয়েছে। মাল্টার পাশাপাশি ওই জমিতে ১০০০ বিভিন্ন জাতের আম, বেশ কয়েকটি কমলা, লেবু ও পেপে গাছ রয়েছে। এ ছাড়াও মুক্তারের আরো দুই একর জমিতে ৪ হাজার পেয়ারা গাছের বাগান রয়েছে।
বাগান মালিক রেজাউল করিম মুক্তার জানান, মাল্টা বাগানই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। প্রথম দুই বছর ফলন আসলেও লাভের আশা না করে তা ছেটে ফেলে দিয়ে মাল্টার চারাগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। তৃতীয় বছর থেকে ফলগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দেন। এতে তৃতীয় বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি হয় তার। চতুর্থ বছরে অর্থাৎ গত বছর প্রায় ১৫ লাখ টাকার মাল্টা বাজারের আড়ৎ দারদের কাছে বিক্রি করেছেন তিনি। চলতি বছর ফলন ভালো হওয়ায় এবং বাজার দর ভালো পেলে মাল্টা বিক্রিতে ৩০ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
তিনি আরো জানান, ১ বছর বয়সী চারা লাগানোর ২ বছর পর থেকেই ফলন আসতে শুরু করে। ফুল, পরাগায়ন এবং খাবার উপযোগী মাল্টা ফল হতেই ৭/৮ মাস সময় লেগে যায়। এক-একটি মাল্টা গাছের যত্মের পেছনে প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার। সেই হারে প্রতি গাছে ৩০০/৪০০টিরও বেশি মাল্টা ফল ধরে। সঠিক যত্ম নিলে এক-একটি মাল্টা গাছ ১০ বছর পর্যন্ত ফলন দিয়ে থাকে। তাই মাল্টা চাষে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
জানা গেছে, মুক্তারের নিজ এলাকার আশপাশসহ প্রতিদিন দূর দূরান্তের বহু মানুষ দেখতে আসেন তার মাল্টা বাগান। সুন্দর মনোরম পরিবেশে সাজানো-গুছানো মাল্টা বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা মাল্টাগুলো দেখে অভিভুত হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। অনেকে বাগান থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন মাল্টা। এর মধ্যে অনেক বেকার যুবক উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেরাও ছোট ছোট মাল্টা বাগান করার চেষ্টা করছেন। মুক্তারও তাদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন।
তবে এ বছর প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ইতিমধ্যে মুক্তারের মাল্টা বাগানে দেখা দিয়েছে সেচ সংকট। তাই সেচ সুবিধার জন্য সরকারের কাছে একটি কৃষি সেচ যন্ত্রের সহায়তার প্রত্যাশা করছেন এই নবীন কৃষি উদ্যোক্তা মুক্তার।
এদিকে সম্প্রতি রায়পুরের হাজিমারা গ্রামে তরুন কৃষি উদ্যোক্তা রেজাউল করিম মুক্তারের মাল্টা বাগান পরির্দশে যান লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বিশাল মাল্টা বাগান দেখে অভিভূত হয়ে বলেন, এমন মাল্টা বাগান, যেমন গাছের গোদ ভালো, তেমনি অধিক ফলন, বিষয়টি মুগ্ধকর। মাল্টা বাগানের ফলন আরো বৃদ্ধির জন্য কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরণের সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। মুক্তারকে দেখে মাল্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। এ অঞ্চলে ভালো সম্ভাবনা থাকায় মাল্টা চাষে দিন দিন আবাদ বাড়ছে। জেলায় এ বছর প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে মাল্টা চাষ হয়েছে।
এসআইএইচ