এখনো উত্তপ্ত সীমান্তের পরিস্থিতি, থেমে থেমে গুলি
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং পাহাড়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে থেমে থেমে গোলাগুলি চলছে। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ছোড়া হয়েছে ১২-১৫টি আর্টিলারি ও মর্টার শেল। তবে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আকাশে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ফাইটার জেট কিংবা হেলিকপ্টারের ওড়াউড়ি দেখা যায়নি। এক মাস ধরে ওয়ালিডং পাহাড়ের পূর্ব দিকে খ্য মং সেক পাহাড়ে স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর যুদ্ধ চলছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ফেরদৌস বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির শব্দ এপারের লোকজনের কানে আসছে। এপারের বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি সতর্কাবস্থায় আছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরটি পড়েছে ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কোনারপাড়া সীমান্ত এলাকায়। এই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, সকাল ৮টা থেকে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের পেছনে মিয়ানমারের ওয়ালিডং পাহাড় থেকে থেমে থেমে ভারী অস্ত্রের গুলি ও মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছে। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত গুলিবর্ষণ হয়েছে। এতে অন্যান্য দিনের মতোই আতঙ্কিত ছিলেন আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা। তাদের ১৫ দিন পরপর আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ত্রাণসহায়তা দেয়। গোলাগুলি চললেও আজ ত্রাণসহায়তা দেওয়া বন্ধ রাখা হয়নি।
ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ আরও বলেন, শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা তরিতরকারি ও মাছ কেনার জন্য ছোট্ট একটি খাল পার হয়ে ঘুমঘুমের তুমব্রু বাজারে আসে। কেনাকাটা শেষে আবার আশ্রয়শিবিরে ফিরে যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের যাতায়াতের অনুমতি নেই। আবার মিয়ানমার থেকে সীমান্ত অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে কেউ যেন ঢুকতে না পারে, এ বিষয়ে সতর্ক বিজিবি। গত ১০-১৫ দিনে মিয়ানমার থেকে কোনো অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে এই ইউপি সদস্য বলেন, ঘুমধুম ইউনিয়নের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সেখানে বিজিবি পাহারা দিচ্ছে।
তুমব্রু বাজারের কোনারপাড়া ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ের মধ্যভাগের জায়গাটুকু নো ম্যানস ল্যান্ড। এখানে (শূন্যরেখায়) আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে পাঁচ বছর ধরে বাস করছে রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবিরের পাশ ঘেঁষেই কাঁটাতারের বেড়া। কাঁটাতারের দক্ষিণে পাহাড়ের সারি। পাহাড়চূড়ায় স্থাপন করা হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) একাধিক চৌকি। ঘুমধুমের তুমব্রু বাজার থেকে এসব খালি চোখেই দেখা যায়।
শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টার দিকে আশ্রয়শিবিরের পেছনে পাহাড়ে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পাহাড়চূড়ার বিজিপির চৌকি থেকে খ্য মং সেক পাহাড়ের দিকে থেমে থেমে ছোড়া হয় ১২-১৫টি আর্টিলারি ও মর্টার শেল। গতকালও বেলা একটা পর্যন্ত আর্টিলারি ও মর্টার শেল ছোড়া হয়। কিন্তু আকাশে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ফাইটার জেট কিংবা হেলিকপ্টারের ওড়াউড়ি দেখা যায়নি।
দিল মোহাম্মদ বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ আগে হয়েছিল ঘুমধুম সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের ৪০-৪১ ও ৩৯ সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকায়। তিন দিন ধরে দুই পক্ষের স্থলযুদ্ধ ওয়ালিডং পাহাড়ের পূর্ব দিকে সরে গিয়ে ঘন গাছপালার খ্য মং সেক পাহাড়ে চলছে।
সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র ও রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, গত ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় খ্য মং সেক পাহাড়ে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের (বিজিপি) একটি চৌকি দখলে নেয় আরাকান আর্মি। এই সংঘর্ষে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ১৯ জন সদস্য নিহত ও ১৪ জনকে অপহরণ করে আরাকান আর্মি। এরপর টানা কয়েক দিন আরাকান আর্মির লক্ষ্যবস্তুতে জেট ফাইটার ও হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণের পাশাপাশি বোমা ও মর্টার শেল ছোড়া হয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ডেও দুদিন একাধিক মর্টার শেল এসে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল। বর্তমানে দুপক্ষের স্থলযুদ্ধ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ক্রমান্বয়ে পূর্ব-পশ্চিম দিকে (রাখাইন রাজ্যে) মংডুর দিকে সরে যাচ্ছে।
খ্য মং সেক পাহাড় থেকে রাখাইন রাজ্যে মংডু জেলা শহরের দূরত্ব মাত্র ১৭ কিলোমিটার। আর ঘুমঘুমের বিপরীতে ওয়ালিডং পাহাড় থেকে দক্ষিণে মংডুর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। মংডু থেকে ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টার ওঠানামা করে পাহাড়ের আরাকান আর্মির লক্ষ্যবস্তুতে গুলি, বোমা, মর্টার শেল নিক্ষেপ করত। মংডুর শহরের পশ্চিমে চার-পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদী অতিক্রম করলে বাংলাদেশের টেকনাফ শহর।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষটা ক্রমান্বয়ে রাখাইন রাজ্যের পূর্ব দিকে (মংডু শহরের দিকে) ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন দুই পক্ষের লোকজনের হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির ঘটনা আগের তুলনায় কমে আসায় ধুমধুম সীমান্তের মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করলেও আতঙ্ক যাচ্ছে না। ওয়ালিডং পাহাড় থেকে থেমে থেমে ছোড়া মর্টার শেলের বিকট শব্দে এপারের ভূখণ্ডও কাঁপছে। তুমব্রু বাজারের দোকানপাট খোলা হলেও লোকজনের তেমন সমাগম ঘটছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমে গেছে। বাংলাদেশ সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে আছে বিজিবি।
এএজেড