কে এই অংথোই মারমা, কেনো তাকে নিয়ে পাহাড়ে এত ঘটনা?
খাগড়াছড়ির গুইমারার দেওয়ান পাড়া এলাকায় গত শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল পৌনে ৯ টার সময় সন্ত্রাসীরা ইউপিডিএফের সংগঠক অংথোই মারমা আগুনকে গুলি করে হত্যা করে। কে এই অংথোই মারমা ওরফে আগুন? কেনো গুলিতে নিহত হলো সে। এরপর যার কারনে আগুনে পুড়েঁছে খাগড়াছড়ি-ঢাকা আঞ্চলিক সড়কে মাল বোঝাই ট্রাক। ভাঙ্গা হয়েছে বেশ কিছু সিএনজি। লাঞ্চিত হয়েছে পথচারী। এখনো আতংকে দিন পার করছে সাধারন মানুষ।
প্রতিবাদে রবিবার (৪ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ির পাঁচ উপজেলায় আধাবেলা সড়ক অবরোধ হয়েছে। সে কারণে বেড়েছে আরো ভয় ও আতংক। শুক্রবার বিকাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাটিরাঙা থেকে রামগড় উপজেলা পর্যন্ত যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রহরা দিয়ে পৌছে দিয়েছে। এরপর ও এখনো জনমনে রয়েছে নিহত আগুনের বিষয়ে ভয়। কখন কি যেনো হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,অংথোই মারমা ওরফে আগুন উপজেলার বুধংপাড়া যৌথ খামার এলাকার মৃত কংলাউ মারমার ছেলে। পারিবারিক জিবনে তার দুটি সন্তান, স্ত্রী ও বয়স্ক মা রয়েছে। লেখা পড়াহীন অংথোই মারমা বড় হয় মানুষের দৈনিক মজুরি করে। পরে ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালাতো সে। ওই সময় ইউপিডিএফের লোকজনকে ভাড়ায় আনা নেওয়া করতো।
২০১৪ সালে গুইমারা বড়ইতলী, শনখোলা পাড়া এলাকায় পাহাড়ি-বাঙ্গালী ভূমি বিরোধের সময় নিজ জাতির পক্ষে সাম্প্রদায়িক ভাবে অংশ নেয়। আর এ অংশগ্রহনকে নিজ জাতির মুক্তির সংগ্রাম মনে করে সে। এরপর যোগ দেয় প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) গুইমারা অঞ্চলের আঞ্চলিক কালেক্টর হিসেবে। ইউপিডিএফের ভাষায় যাকে বলে সংগঠক। তার কালেক্টর জীবন প্রায় ১০-১৫ বছরের অধিক হবে। লেখা পড়ার কারনে আর পদায়ন হয়নি তার। তবে অতিরিক্ত সাহসী ছিলো আগুন। যার দ্বারা গুইমারা অঞ্চলের সাধারন মানুষ সব সময় আতঙ্ক থাকতে হতো।
আগুন-এর কথাবার্তা, আচার আচরণ ছিলো খুবই উগ্র এবং সাম্প্রদায়িক। অদম্য সাহসী আগুন যে এলাকায় পার্টির দায়িত্ব পালন করতেন, সে এলাকায় স্বামীর উপস্থিতিতে ও নারীদের নিরাপত্তা ছিলো না। এসব কারনে তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে কয়েকবার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার চিংগুলি পাড়া এলাকায় একজন বলেন, গভীর রাতে তারা স্বামী স্ত্রী গুমাচ্ছে। এমন সময় আগুন সাহেব এসে তাদের বললো মুরগি জবাই করে রান্না করতে, তিনি ভাত খাবেন। যে কথা সেই কাজ। স্বামী, স্ত্রী মুরগি জবাই করে রান্না করতে শুরু করলো। রান্না শেষে আগুন সাহেব নিজেরমত করে খেয়ে, স্বামীকে বলে অন্য রুমে ঘুমাতে। তার স্ত্রীর সাথে আগুন সাহেব থাকবে।
বেচারা স্বামী যখন বিষয়টি মানতে নারাজ, তখন আগুন সাহেব স্বামীর দিকে অস্ত্র তাক করলেন। এরপর স্বামী, স্ত্রী দুই জনই ভয়ে নিরুপাই। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে সারা রাত ব্যবহার করলো আগুন। সকালে লজ্জায় স্বামী, সন্তানকে রেখে মহিলাটি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্ম হত্যা করে। এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে বৈঠক হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়া হয়। এলাকার ছড়া বা খালে স্থানীয় নিজ জাতির নারীদের গোসল করার সময় শারিরীক সর্ম্পকের জন্য আক্রমনসহ এমন বহু ঘটনা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
স্থানীয় যে কোন ঘটনায় জনপ্রতিনিধি ,মৌজা প্রধান, থানা পুলিশের আগে আগুনের মুখোমুখি হওয়া লাগতে অনেকের। তার সাথে অস্ত্র থাকতো সবসময়। যার কারনে যে কেও ভয়ে থাকতো তার সামনে। উপজেলা ব্যাপি জানা ছিলো আগুন মানেই আগুন। টাকা ছাড়া পানি হবে না। তার সকল কর্মকাণ্ডে ভয় পেতো সবাই। আগুনের সম্পর্কে সবার জানা ছিলো, যে তিনি যাই বলেন তাই করেন।
ইউপিডিএফের কমান্ডার তানিমং তার ভেরিফাইড ফেসবুকের মাধ্যমে জানান, শত্রুর বেস্টনিতে গিয়ে সাহসিকতার সাথে কাজ করতে পারা গুইমারা এলাকার এমন একটি সহসীকতার নাম হল অংথোই মারমা (আগুন)। তিনি ইউপিডিএফ সদস্য অংথোই মারমা (আগুন কে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অবিলম্বে হত্যার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, অংথোই মারমা ওরফে আগুন মূলত গুইমারা অঞ্চলের জন্য একটা ত্রাস ছিলেন। তার চাঁদাবাজি ও অত্যাচরে এ অঞ্চলের মানুষ ভীত ও অতিষ্ঠ ছিলো। নাম প্রকাশ না শর্তে গুইমারার একাধিক কৃষক, দিন মজুর, শ্রমিক, জুম চাষী ও ব্যবসায়ী এমন কি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, অংথোই মারমা ওরফে আগুনের বিশাল বাহিনী রয়েছে গুইমারায়। তার নেতৃত্বে গুইমারা ও সিন্দুকছড়ি এলাকায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি হতো।
বাজারে কৃষক কাচাঁমাল নিয়ে আসলেও তার চাঁদা বাধ্যতামূলক ছিলো। এ ছাড়া কাঠ ব্যবসায়ী, বাঁশ ব্যবসায়ী, গাড়ী চালক, যে সব পাহাড়ি জুম চাষ করেন তাদেরও চাঁদা দিতে হতো। কিন্তু এতোদিন তিনি ছিলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অবশেষে শুক্রবার সকালে প্রতিপক্ষের গুলিতে অংথোই মারমা ওরফে আগুন নিহত হন। কিন্তু এখানে থেমে নেই তার গল্প। অংথোই মারমা ওরফে আগুন নিহত হওয়ার পর তার সহকর্মীরা খাগড়াছড়ি জেলার পশ্চিম অংশে আগুন দিয়েছে।
গেলো শুক্রবার ইউপিডিএফ নেতা অংথোই মারমার হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি-ঢাকা আঞ্চলিক সড়কের বাইলাছড়ি ও দাতারাম পাড়া এলাকায় রাস্তা ও যানবাহনে আগুন দিয়েছে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা। ভেঙ্গেছে বেশ কিছু সিএনজি। নাজেহাল ও লাঞ্চিত হয়েছে অসংখ্য যাত্রী।
বাইল্যাছড়িতে সন্ত্রাসীদের আগুনে পুড়ে যাওয়া ট্রাকে মালিক মো: দাউদুল ইসলাম ভূইয়া জানান, কয়েক দিন আগে তিনি ট্রাকটি কিস্তিতে কিনেছেন। চালকের কাছ থেকে জানলাম, সন্ত্রাসীরা চালকের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তার নতুন ট্রাকটি আগুনে পুড়িয়েছে।
রামগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: মিজানুর রহমান জানান, ধর্মপ্রাণ মসুলমানরা যখন নামাজে ব্যস্ত, ঠিক সে সময় রামগড় উপজেলার দাতারাম পাড়া ও গুইমারা উপজেলার বাইল্যাছড়িতে পৃথকভাবে মাল বোঝাই ট্রাকে এ আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কিছু সিএনজি ভাংচুর ও যাত্রীদের মারধর করা হয়।
খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌছলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। ফলে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। দাতারামপাড়া ট্রাকে আগুন দেওয়ার ঘটনায়, ট্রাকের হেলপার কামরুল ইমলাম বাদী হয়ে মামলা করেছেন। রাস্তা ও যানবাহনের অগ্নিসংযোগের পর থেকে মাটিরাঙা থেকে রামগড় উপজেলা পর্যন্ত যানবাহনগুলোকে প্রহরা দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ।
গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: রশীদ জানান,গুলির শব্দ শুনে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত অংথোই মারমা ওরফে আগুনের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্ত শেষ করে স্বজনদের নিকট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর একদিন পর নিজ ধর্মের পাশাপাশি ইউপিডিএফের রীতিনীতি ও সংগঠনের পতাকা মুড়িয়ে দাহ করা হয় আগুনের লাশ। একই দিনে হত্যা, অস্ত্র উদ্ধার ও গাড়ি পোড়ানোর বিষয়ে গুইমারা থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। হত্যা ও অস্ত্রের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ও ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ট্রাকের হেলপার বাদী হয়ে মামলা করেছে। মামলা গুলোর তদন্ত চলমান রয়েছে।
এখানে থেমে নেই, প্রতিপক্ষের গুলিতে সন্ত্রাসী অংথোই মারমা নিহত হওয়ার পর খাগড়াছড়ি জেলার পাঁচ উপজেলায় রবিবার আধাবেলা সড়ক অবরোধ ডেকেছে প্রসীতের ইউপিডিএফ। শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নিরন চাকমা স্বাক্ষরিত সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা এই অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। বিবৃতিতে তিনি অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে সকল যানবাহন মালিক-চালক ও শ্রমিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
অবরোধ চলাকালে জরুরী ফায়ার সার্ভিস, এ্যম্বুলেন্স ও লাশবাহী গাড়ি, জরুরী ঔষধ সরবরাহকারী ও সংবাদপত্র বহনকারী যান, সংবাদ সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত সাংবাদিকদের গাড়ি এই অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে বলে জানানো হয় বিবৃতিতে। কিন্তু অবরোধ শেষে বিকাল পাঁচটায় গুইমারা উপজেলার বাইল্যছড়িতে আবার গুলি বর্ষণ ও দুটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয় সংগঠনের সদস্যরা।
অপরদিকে উপজেলার সাধারন মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে ,চাদাঁমুক্ত শান্ত পরিবেশে বসবাস করতে চায়।নতুন কোন আগুনের সৃষ্টি হোক তারা আর চায়না।এজন্য প্রশাসনকেই ব্যবস্থা নিতে বলছেন তারা।
এএজেড