চট্টগ্রাম বন্দরের মাথা ব্যথা ‘মিথ্যা ঘোষণার চালান’
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণ ও সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আসছে শত শত কোটি টাকার পণ্যের চালান। যা মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনটিই জানালেন চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক।
তিনি জানান, চলতি ডিসেম্বর মাসে এ পর্যন্ত মিথ্যা ঘোষণায় আনা চারটি চালান আটকা পড়েছে। এসব চালানে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছে।
এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) আপেল ঘোষণা দিয়ে আরব আমিরাত থেকে আনা ২২ লাখ ১৯ হাজার শলাকা বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট ধরা পড়ে। এই চালানে ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা করা হয়েছে। চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার স্টেশন রোডের মারহাবা ফ্রেশ ফ্রুট এই চালানের আমদানিকারক।
এর আগের দিন বুধবার (২২ ডিসেম্বর) চীন থেকে এ ফোর সাইজ প্রিন্টিং পেপারের ভেতরে লুকিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আনা ১ কোটি ৬২ লাখ পিস সিগারেটের জাল স্ট্যাম্প ধরা পড়ে। এতে ১২০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল চট্টগ্রামের জুবিলী রোডের আরফাত এন্টারপ্রাইজ।
এর আগে ১৪ ডিসেম্বর চীন থেকে আর্ট পেপারের ভেতরে লুকিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আনা ৩ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার পিস নিম্নস্তরের ১০ শলাকা বিশিষ্ট সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহার উপযোগী হালকা খয়েরি রংয়ের জাল স্ট্যাম্প জব্দ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস।
এর আগে ১১ ডিসেম্বর ২৫ টন পলেস্টার সুতার মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা ৯.৮৬ টন কেমিক্যাল জাতীয় পণ্য জব্দ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস। ময়মনসিংহ ভালুকার প্রতিষ্ঠান পিএনআর ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এসব পণ্য আমদানি করে। চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল প্রতিষ্ঠানের মনোনীত আগ্রাবাদের সিএন্ডএফ এজেন্ট রাসেল গার্মেন্টস।
এভাবে চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি কন্টেইনার ভর্তি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট জব্দ করে কাস্টমস। বাংলাদেশ টেক্সটাইল অ্যান্ড কেমিক্যাল ফাইবার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি চীন থেকে কাপড় ও কাপড়ের সরঞ্জাম আনার মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এক কোটি ১৩ লাখ শলাকা সিগারেট আমদানি করে। যেখানে শুল্ক-করসহ ২৭ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
একইভাবে ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি সাড়ে ২৩ হাজার কেজি সুতার পরিবর্তে জব্দ করা হয় বালুর বস্তা। এর কিছুদিন পর ৪ ফেব্রুয়ারি চীন থেকে ৪০ ফুট লম্বা কন্টেইনারভর্তি বালুর বস্তা আসে। অথচ এসব কন্টেইনারে ৪৯ হাজার ৬৯৭ ডলার মূল্যের সুতা আসার ঘোষণা ছিল। একইভাবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে চীন থেকে তুলা আমদানির ঘোষণায় আনা তিন দফায় কন্টেইনার ভর্তি বালু ও মাটি জব্দ করা হয়।
কাস্টমসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪২৯টি মিথ্যা ঘোষণা শনাক্ত করে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কাস্টমসের এআইআর শাখার তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে মিথ্যা ঘোষণা এবং ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আনার খবর পেয়ে এক হাজার ৭৩৯টি চালান আটক করা হয়।
এরমধ্যে ৭৪১টি চালানে ৪৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে আমদানিকারক। মিথ্যা ঘোষণা ও ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আনার দায়ে এসব চালানে ৫৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকাসহ মোট ১০৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
বন্দর ব্যবহারকারীদের তথ্যমতে, প্রতিমাসে এভাবে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিষিদ্ধ ও শুল্কযোগ্য পণ্য আমদানি করছে কতিপয় অসাধু আমদানিকারক। কাস্টমসে ঘুষ বাণিজ্যের ফলে সরকারের প্রাপ্য হাজার হাজার কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ায় অসাধু আমদানিকারকরা এই পথ বেছে নিয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, কাস্টমস যেখানে আপস করে সেখানে দুর্নীতি হয়। কাস্টম দুর্নীতি না করলে কারো সাধ্য নেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করার। এসব অনিয়মের সঙ্গে কাস্টমসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে সংঘবদ্ধ চক্র পণ্য আমদানিতে মূল্যের অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড, ওজন, পরিমাণ, গুণগতমান প্রভৃতিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার মো. সালাউদ্দিন রিজভী বলেন, কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরদার করা হয়েছে। যে কোনো ধরনের অনিয়মের দায়ে আমদানিকারকসহ সিএন্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া জরিমানা বাড়ানোর পর মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি কমেছে। এরপরও যারা এসব অনিয়মের সাথে সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
/এএন