৭ শহীদের গণকবরের জায়গায় বাণিজ্যিক স্থাপনা!
ইনসেটে শহীদ ডা. দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ।
সিলেটে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৭ শহীদের গণকবরের জায়গায় গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। তা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা এবং আত্মীয়ের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
শহীদ সাতজনের পরিবার সূত্রে ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টায় চারদিকে বিজয়ের ডামাডোল বাজছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর বাংলার আকাশে বিজয় নিশান উড়বে, পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। যে কারণে রেডিওতে কান পাতছিলেন ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ। এমন সময় হঠাৎ একটি মর্টার শেল এসে পড়ে তাদের ঘরে! মুহূর্তে লাশের সারি তৈরি হয়ে যায়। আহত হয় অনেকে। তড়িঘড়ি করে আহতদের নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েকজনের মৃত্যু হয়। কিন্তু ধর্মীয় রীতি মেনে একজনকে দাহ করা হয়। শহীদ ৯ জনের মধ্যে ৭ জনকে দেওয়া হয় গণকবর। সাত মাসের শম্পা এন্দকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিতে।
মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে সিলেট নগরীর মির্জাজাঙ্গাল এলাকায়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের সময় সেই ঘটনা এখন অনেকটা অজানা সেই স্মৃতি। সেখানে নেই গণকবরের কোনো চিহ্ন। মেলেনি শহীদের স্বীকৃতিও। বরং গণকবরের জায়গায় হয়েছে বাণিজ্যিক স্থাপনা!
এসব বর্ণনা দেওয়ার সময় শহীদ ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ'র নাতী সিলেটের রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী প্রতীক এন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমার বয়স তখন মাত্র এক বছর। তাই ভাগ্যগুনে বীভৎস ঘটনাটি বুঝতে পারিনি। পরে আমার আহত বাবার মুখ থেকে শুনেছি। আমার বাবা পার্থ শখা এন্দ নিজেও আহত হন। ব্যাপারগুলো এক দিক থেকে যেমন বেদনার তেমনই গৌরবের। কিন্তু ব্যথা লাগে যখন দেখি সবাই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু আমাদের পরিবারের নিহতরা কেউ শহীদের স্বীকৃতি পাওয়া দূরের কথা বরং যেখানে তাদের সমাহিত করা হয়েছিল সেই জায়গায় একটি স্মৃতি ফলকও হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমার দাদা ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ ছিলেন সে সময়কার মিউনিসিপ্যালিটি (পৌরসভার অবসরপ্রাপ্ত) চিকিৎসক। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন মির্জাজাঙ্গাল এলাকায়। যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেটি নয়া সড়কের বিশ্বম্ভর আখড়ার সম্পত্তি ছিল। যখন মর্টার শেলটি পড়ে তখন আমার পরিবার নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন মণিপুরি রাজবাড়ীর বর্তমান ৩৪ নম্বরের বাসায়। তখন সেটিতে থাকতেন আব্দুর রহমান চৌধুরী। তিনি ছিলেন বায়না সূত্রে ওই বাসার মালিক। পরিবারের নারী সদস্যদের কথা বিবেচনায় ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া। সেখানেই মর্টারটি পড়ে। শেলের প্রচণ্ড আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আমার দাদা ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্ৰ এন্দ, তাঁর স্ত্রী সুনীতি বালা এন্দ এবং আত্মীয় প্রকৌশলী গোপেশ দাস। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকালে মারা যান ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্ৰ এন্দর জোষ্ঠপুত্র আমার কাকু দিব্যেন্দু এন্দ, কন্যা শিখা এন্দ এবং দিব্যেন্দু এন্দ'র পুত্র অপু এন্দ। তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে প্রাণত্যাগ করেন ডা. দিগেন্দ্র'র আরেক কন্যা শিবানী এন্দ এবং দিব্যেন্দু এন্দ, সাত মাসের শিশুকন্যা পম্পা এন্দ। সাতদিন পর মারা যান ডা. দিগেন্দ্রের পুত্রবধূ ও দিব্যেন্দু এন্দর স্ত্রী খনা এন্দ। পরে ধর্মীয় রীতি মেনে তাঁকে দাহ করা হয়।’
শহীদের স্বীকৃতি না পেলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক ও শহীদ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের তালিকা নিয়ে বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ সম্পাদিত 'মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ' নামক গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ পরিবারের গল্প। বীরত্বগাথা মর্মান্তিক এ ঘটনাটি তাজুল মোহাম্মদের লেখা 'সিলেটে গণহত্যা' বইয়েও উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে মর্টার শেলটি কারা ছুড়েছিল তার কোন সঠিক তথ্য মেলেনি। অনেকের ধারণা মর্টার শেলটি পাকবাহিনীকে লক্ষ্য করে মুক্তিবাহিনী ছুঁড়েছিলেন। যা ভুলক্রমে পড়ে এন্দ পরিবারের ওপর।
এদিকে সরেজমিনে মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় মণিপুরী রাজবাড়ীর মন্দিরের বিপরীতে যেখানে ডা. দিগেন্দ্র পরিবারের ৭ সদস্যকে সমাহিত করা হয় সেখানে গিয়ে দেখা যায় বাণিজ্যিক স্থাপনা দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে গণকবরের স্মৃতিময় জায়গা। কোথাও কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই।
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক ও ডা. এন্দ পরিবারের আশ্রয়দাতা আব্দুর রহমান চৌধুরীর ছেলে আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘২০১১ সালে 'নিনাই' (নির্বিক,নান্দনিক ও ইস্পাত দৃড়) নামের একটি সংগঠন থেকে একবার এখানে সমাহিত শহীদদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানো হয়। সে সময় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এখানে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। পরে মেয়র পরিবর্তন হলে এটি আর হয়নি বরং এরপর রাতারাতি বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি হয়েছে।’
যে জাতি তার ইতিহাস ভুলে যায় সে সমৃদ্ধ হতে পারে না এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসেও যদি গণকবর চিহ্নিত করা না যায় সেটি লজ্জার বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাসান মোরশেদ। তিনি বলেন, ‘মৃত্যু যাদের মর্টার শেলেই হোক সেটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। সুতরাং শহীদের স্বীকৃতি পাওয়া তাদের অধিকার। এমনকি এখানে একটি স্মৃতিফলক করে চিহ্নিত করা উচিৎ।’
অপরদিকে ওই জায়গার মালিক বিশ্বম্ভর আখড়ার পরিচালক গৌতম দাস বলেন, 'সকলকেই একটি গর্তে সমাহিত করা হয়েছে। তাই যেখানে সমাহিত করা হয়েছে সে জায়গাটি খালি রেখে বাকিটা স্থাপনা করা হয়েছে।'
এখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা যায় কি না এমন প্রশ্নে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘ব্যাপারটি আমার জানা নেই। যদি কেউ তথ্য প্রমাণ দিয়ে আবেদন জানান তাহলে আমরা সিসিকের পক্ষ থেকে এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেব।’
/এএন