পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র: গুরুত্বপূর্ণ যে পাঁচ তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন
দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সোমবার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই কেন্দ্রের থেকে প্রতিদিন এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় উপজেলার ধানখালীতে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ কেন্দ্র।
বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে এখন তেল বা ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কুইক রেন্টালের আরেকটি বিকল্প তৈরি হয়েছে।
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি তথ্য জেনে রাখতে পারেন:
১. চীন-বাংলাদেশের যৌথ প্রকল্প পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে। ২০১৪ সালে এই সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছিল। নির্মাণের কাজ করেছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। আড়াইশো কোটি ডলার ব্যয়ে এই কেন্দ্র নির্মাণের সিংহভাগ অর্থায়ন করেছে চীন।
এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ধানখালী গ্রামের এক হাজার একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।
এর কাছেই রয়েছে পায়রা বন্দর। যেখান থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি কয়লা আমদানি সহজ হবে বলে সরকার আশা করছে। কর্মকর্তারা আশা করছেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হবে।
২. এক বছরের বেশি সময় পরে বিদ্যুতের ব্যবহার পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সোয়া এক বছর আগে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে গেলেও, সঞ্চালন অবকাঠামোর কারণে গত এক বছরে কাজে লাগানো যায়নি। পরীক্ষামূলক চালানোর পর ২০২০ সালের ১৫ মে প্রথম কেন্দ্রটি পুরোপুরি উৎপাদনে আসে। আর দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে কাজ শুরু করে সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে। তবে সঞ্চালন লাইন পুরোপুরি নির্মাণ শেষ না হওয়ার কারণে সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়নি।
এখন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত, আমিনবাজার-মাওয়া-গোপালগঞ্জ-মোংলা পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন এই প্ল্যান্টে ৭০০ থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।
৩. দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ সঙ্কট দূর করবে সরকার বলছে, বাংলাদেশের বিদ্যুতের বিপুল চাহিদার এক দশমাংশ পূরণ হবে পায়রার এই একটি কেন্দ্র থেকে। এখানকার বিদ্যুৎ দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুতের সমস্যা অনেকাংশে মিটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প-কারখানা ও উন্নয়নের যে আশা করা হচ্ছে, সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই কেন্দ্রটি। পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ২১ লাখ।
বাংলাদেশের পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। তবে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত বছরের ২৭ এপ্রিল। সক্ষমতা থাকলেও গড় উৎপাদন হচ্ছে নয় থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ১১৬০ মেগাওয়াট। বাংলাদেশে এখন ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎই আসছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে এবং বাংলাদেশে বিদ্যুতের উচ্চমূল্য নিয়ে বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোকেই দায়ি করা হয়।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা থাকলেও সঞ্চালন ও সরবরাহ লাইনের অভাব থাকায় বিদ্যুতে গ্রাহকদের কাছে সেটি ঠিকমতো সরবরাহ করা যায় না। বাংলাদেশে প্রতিদিনের বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও অনেক গ্রাহকই ঠিকমতো বিদ্যুৎ পান না। বিশেষ করে এ জন্য সবচেয়ে বেশি ভুগছেন গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারা।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) ২০২০ সালে একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয়, বাকি ৫৭ শতাংশ অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেয়া হয়।
তবে আশা করা হচ্ছে, এই বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হলে সরকার কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচও কমে যাবে।
৪. কয়লা ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন ১২ হাজার টনের বেশি কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে বঙ্গোপসাগরের রামনাবাদ চ্যানেল হয়ে কয়লা আসে। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকেও আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ যখন শুরু হয়, তখন থেকে সেখানকার পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আলোচনা ওঠে।
সরকারের বিদ্যুৎ খাতে ২০১৬ সালের মহা-পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। যেখানে আমদানি ও নিজস্ব গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, আমদানি নির্ভর কয়লায় ৩৫ শতাংশ, তেল, বিদ্যুৎ আমদানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাকি ৩০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশও সর্বশেষ জলবায়ু সম্মেলনে কয়লার ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পরিকল্পনায় থাকা ১০টি কয়লানির্ভর কেন্দ্র বাতিল করেছে সরকার কিছুদিন আগে।
যদিও সরকার শুরু থেকেই বলে এসেছে, পরিবেশের ক্ষতি না করে করা হবে এ কাজ। কিন্তু কার্যত গত কয়েক বছরে সেখানকার পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন স্থানীয় মানুষেরা।
ধানখালী গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক মুস্তাফা তুহিন বলছিলেন, গাছপালায় কালো ছোপছোপ পড়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলেছে ওটা ছত্রাক বা ফাঙ্গাস। কিন্তু নারকেল ও অন্যান্য গাছপালায় আগে তো ছত্রাক ছিল না, হঠাৎ ২/৩ বছরে ছত্রাক আসলো কোথা থেকে? আর গাছপালার ফলনও কমে গেছে।
সরকার বলছে, পরিবেশের ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে এই কেন্দ্রে আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ.এম খোরশেদুল আলম বলছেন, বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ড মেনেই বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে এখানে এবং কার্বন ও সালফার নিঃসরণের মাত্রা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ।
তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, এরপরেও পরিবেশের ক্ষতি হবেই। তারা বলছেন, সরকারের উদ্যোগের ফলে ক্ষতির পরিমাণ কমতে পারে, কিন্তু নির্মূল হবে না।
পরিবেশবাদীদের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনা বিষয়ক কর্মজোটের সদস্য-সচিব হাসান মেহেদী বলছেন, ফ্লাই-অ্যাশের পরিমাণ কমলেও যে পরিমাণ নিঃসরণ হচ্ছে আর হবে সেটির ব্যবস্থাপনা কঠিন।
তিনি বলছেন, ‘ধরুন আগে হয়ত ১০০ গ্রাম ছাই হত এখন ৭০ গ্রাম হবে। এখনো বছরে ২০ লাখ টন ছাই হবে, সেই ছাইয়ের ব্যবস্থাপনা কঠিন কাজ। এর বাইরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা ঠাণ্ডা করার জন্য যে পানি ব্যবহার হবে সেটি ডিসচার্জ হবে রামনাবাদ চ্যানেল এবং পাশের নদীতে। সমস্যা হচ্ছে ইলিশের একটি অভয়ারণ্য, এবং গত এক বছর ধরে ওখানে ইলিশের সংখ্যা কমে গেছে বলে স্থানীয় মানুষেরা বলছে।’
বাংলাদেশে রামপাল, মাতারবাড়ি প্রকল্পসহ আরও কয়েকটি বড় আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
৫. আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি পরিবেশ রক্ষায় যে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বা প্ল্যান্টের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা হয়, তাকে বলা হয় আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি। এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৩ তম দেশে পরিণত হয়েছে।
এশিয়ায় ভারত, চীন, তাইওয়ান, জাপান ও মালয়েশিয়ায় আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এ.এম খোরশেদুল আলম বলেছেন, ঢাকনিযুক্ত কোল ইয়ার্ড ব্যবহার করার ফলে বাতাসের মাধ্যমে খোলা কয়লার গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কমে যাবে। ফলে পরিবেশ দুষণের সম্ভাবনাও থাকবে না।
এমএসপি