‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ শুনেই আমরা বুঝেছি যে এ জাতিকে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পথ ছাড়া আমাদের স্বাধীনতার আর কোনো বিকল্প নাই। তাই ৭ মার্চের ভাষণের পরই যুদ্ধের জন্য ঘর ছেড়ে ট্রেনিং নিতে বেরিয়ে পড়ি, যুদ্ধ করি। এদিকে আমি যুদ্ধে যাওয়ায় হানাদাররা আমার বাবাকে মেরে ফেলে। খবর পেয়ে এসে বাবাকে দাফন করে আবারও যুদ্ধে যাই।’
কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বতর্মান বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবদুল মোতালেব মৃধা। ৭ মার্চ ও মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
তিনি বলেন, ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। ৩ ডিসেম্বর বরগুনা মুক্ত হওয়ার পর আমরা পাথরঘাটায় গিয়ে অবস্থান করি। এর মধ্যে শুনতে পারি ১২ ডিসেম্বর হানাদাররা আমার বাবাকে মেরে ফেলে। এরপর আমি বরগুনা এসে বাবাকে দাফন করে মায়ের সঙ্গে দেখা না করেই আবারও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই। আমি এবং তৎকালীন ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর বুকাবুনিয়ার সেকেন্ড ইন কমান্ড আলমগীর সার্কিট হাউজে অবস্থান নেই। ১৬ ডিসেম্বর রেডিওর মাধ্যমে প্রথম জানতে পারি দেশ স্বাধীন হয়েছে। এর মধ্যে তৎকালীন ওসি সাহেব এসেও আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর দেন। বাবার মৃত্যুতে হৃদয় ভারাক্রান্ত থাকলেও মুক্তির আনন্দে সেদিন ওয়াবদা এলাকায় গিয়ে ১ হাজার গুলি ছুড়ে বিজয়োল্লাস করেছিলাম।
মুক্তিযোদ্ধা মোতালেব মৃধাসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও বরগুনার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পরে বরগুনার মুক্তিকামীরা রাইফেল, বন্দুক ও বাঁশের লাঠি নিয়ে বরগুনার বিভিন্ন স্থানে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতির মধ্যে ২৬ এপ্রিল পাকবাহিনী পটুয়াখালী জেলা দখল করে ফেলে। এ যুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ভয়ে বরগুনার মুক্তিযোদ্ধারা এলাকা ছেড়ে চলে যান।
পাকবাহিনী ১৪ মে বরগুনা এসে বিনা বাধায় বরগুনা শহর দখল করে এবং পাথরঘাটায় বিষখালী নদীর তীরে নির্মম গণহত্যা চালায়। তারপর অন্য থানাগুলো দখল করে পটুয়াখালী চলে যায়। ২৬ মে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন শাফায়াতের নেতৃত্বে ৪ জন পাক সেনা বরগুনা আসে এবং ২৯ ও ৩০ মে বরগুনা জেলখানায় ৭৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তাদেরকে জেলা কারাগারের দক্ষিণ পাশে গণকবর দেওয়া হয়।
এদিকে বরগুনার তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা আধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তারা বুকাবুনিয়ার সাব-সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র আবদুস সত্তার খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ২১ সদস্যের একটি দল বরগুনাকে মুক্ত করার পরিকল্পনা নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে বেতাগীর বদনীখালী নামক স্থানে তারা অবস্থান নেয়। তারা তাদের এক সহকর্মীকে র্যাকি করার জন্য বরগুনা পাঠায়। তার সংকেত পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একটি বড় বাচারী নৌকাযোগে বিষখালী নদী দিয়ে বরগুনা রওনা হয়। রাত ৩টার দিকে তারা বরগুনার খাকদোন নদীর তীরে পোটকাখালী নামক স্থানে অবস্থান নেন।
বরগুনাকে মুক্ত করার কৌশল হিসেবে তারা বরগুনা কারাগার, ওয়াপদা কলোনী, জেলা স্কুল, সদর থানা, ওয়ারলেস স্টেশন, এসডিও'র বাসভবনসহ বরগুনা শহরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন। এরপর তারা হেঁটে বরগুনা শহরে এসে যে যার অবস্থান নেন। তারা ফজরের আজানকে অভিযান শুরুর সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে। আজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ৬টি স্থান থেকে একযোগে গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। রাজাকার এবং পাকিস্তানপন্থী পুলিশরা তখন নিরাপত্তার জন্য জেলখানায় আশ্রয় নিয়েছিল। কোনো প্রতি উত্তর না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয় দফা গুলি করে জেলখানার দিকে অগ্রসর হয়। জেলখানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করিয়ে তারা তৎকালীন এসডিও আনোয়ার হোসেনের বাসায় যান। এরপর ট্রেজারির সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত গেয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকসহ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে ৫ সদস্যর একটি দল গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে অনুসন্ধান দলের অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান, সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, এস এম রাশেদুল হাসান এবং এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর।
এর আগে, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের কথা মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) জানিয়েছিলেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, আশ্রায়ণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বেজা ও বেপজার বিভিন্ন প্রকল্পসহসহ ৯টি প্রকল্পে অন্তত ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ লুটপাট করা হয়ছে। এসব অর্থ আত্মসাৎ ও দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে কমিশনের বৈঠকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এর আগে গত ১৫ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (আরএনপিপি) থেকে ৫০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে কারখানা আধুনিকায়নের কথা বলে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষিত রংপুর চিনিকল পুনরায় চালুর খবরে এলাকায় বইছে খুশির বন্যা। উপজেলার মহিমাগঞ্জে অবস্থিত গাইবান্ধার একমাত্র কৃষিভিত্তিক ভারি শিল্পকারখানা রংপুর চিনিকল।
লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে বিগত ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫টির মধ্যে যে ছয়টি চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রায়াত্ত এ চিনিকলটি।
কিন্তু গত ১৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে মাড়াই স্থগিতকৃত ছয়টি চিনিকলের মাড়াই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্তের খবর ছড়িয়ে পড়লে আখচাষীসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। এ জনপদের মানুষ নতুন করে দেখতে শুরু করেছেন সুদিনের স্বপ্ন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ ডিসেম্বর একটি চিঠি বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আফরোজা বেগম পারুল স্বাক্ষরিত ৩৬.০০.০০০০.০৬৪.৯৯.০১২.২৪.১৬৪ নাম্বার স্মারকে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন-এর অধীন মাড়াই স্থগিতকৃত চিনিকল সমূহে পুনরায় মাড়াই কার্যক্রম চালুকরণ শিরোনামের বিএসএফআইসি’র চেয়ারম্যান (গ্রেড-২) এর বরাবরে একটি পত্র প্রদান করা হয়। এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকার আখচাষীসহ সকল স্তরের মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে শুরু করে।
রংপুর চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষীসহ এলাকার লোকজন অভিযোগ করেন, ২০২০-২১ বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও সর্বোচ্চ মাড়াই ক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণ জমিতে দণ্ডায়মান আখ জমিতে রেখে একেবারে শেষ মুহূর্তে এ সিদ্ধান্ত নেয়ায় বিক্ষুব্ধ আখচাষী ও শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার প্রতারণার মাধ্যমে এবং শ্রমিক আন্দোলন বা চাষীদের করুণ আকুতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয় বলে অভিযোগ করেন শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষী নেতারা।
তাঁরা বলেন, তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষীদের উদ্দেশ্যে দেশের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল, আধুনিকায়নের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবার চালু করা হবে এই চিনিকলসহ সব ক’টি চিনিকল। কিন্তু প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম এই রংপুর চিনিকলটি চালু হয়নি গত পাঁচ বছরেও। বরং এ চিনিকলের স্থায়ী চাকুরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে চলমান অন্য চিনিকলে।
কাজ হারানো ‘কাজ নাই, মজুরি নাই’ (কানামনা) চুক্তিভিত্তিক অর্ধসহস্রাধিক শ্রমিকরা এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিক্সা চালনাসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে চালু রাখা পার্শ্ববর্তী চিনিকলের চাইতে অধিক মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন ও অধিক পরিমাণ আখ উৎপাদিত হলেও রহস্যজনক কারণে এ কলটি বন্ধ করায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ছিলেন এলাকার হাজার হাজার আখচাষীসহ সাধারণ মানুষ।
চিনিকল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের শাসনামলে আধুনিকায়নের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি-বাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ^ ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার আওতাধীন চিনিকলগুলোকে। এসব ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর। রংপুর চিনিকলের বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসানের প্রধান কারণ বিশ^ ব্যাংকের এই ঋণ বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
গত চার বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানার চত্বর ভরে গেছে জঙ্গলে। এই দৃশ্য দেখলে মানুষের সরব উপস্থিতির অভাব নিশ্চিত হওয়া যায় খুব সহজে। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলোও ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে এখন মরিচার রাজত্ব। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো। আখচাষী আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। হাজারো মানুষের একসময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি এখন গো-চারণভূমি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণ কাজ। ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছর পর শেষ হয় মিলটির নির্মাণ কাজ। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে। পশ্চিম জার্মানির বাকাউ-উলফ নামের একটি কোম্পানি থেকে আনা মেশিনে ৩৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠে মিলের কারখানা ও কার্যালয়। ১৯৭২ সালে রংপুর চিনিকলসহ সকল চিনিকলকে রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেন।
এ চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিংয়ের জায়গা ৮ একর, সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০টি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র এবং ৮টি সাবজোন। এছাড়াও মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮৩২ একর। ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে ৫ হাজার ৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। এ সময়কালে ৫৬ লক্ষ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি।
রংপুর চিনিকলের ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এখানকার পাওয়ার হাউজে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো। চিনিকলের আখ পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব রেলপথ। সেই রেলপথে নিজস্ব রেলের ইঞ্জিন ও মালবাহী বগি দিয়ে পরিবহণ করা হতো আখ, চিনি, চিটাগুড় ও জ্বালানিসহ নানা দ্রব্য।
রংপুর চিনিকলকে ঘিরে জাঁকজমক ছিল মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশন। বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে মহিমাগঞ্জ। শিক্ষার প্রসারেও অন্যতম ভূমিকা রাখে রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়। সবকিছু মিলিয়ে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষীসহ অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ সৃষ্টি করেছিল রংপুর চিনিকল।
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইনচার্জ) মাসুমা আকতার জাহান জানান, রংপুর চিনিকলসহ মাড়াই স্থগিতকৃত ছয়টি চিনিকল পুনরায় চালুর বিষয়টি আমিও শুনেছি। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এই চিনিকলটি চালু হলে অবশ্যই লাভজনক অবস্থায় উন্নীত হবে। কারণ এখানকার মাটি ও পরিবেশ আখ চাষের জন্য খুবই উপযোগী।
রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান সুজা জানান, দেশের কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে বিগত স্বৈরাচারী সরকার রাষ্ট্রায়াত্ত চিনিশিল্প বন্ধ করে দেয়ার গভীর চক্রান্ত করেছিল। চিনিকলটি বন্ধ হয়ে থাকায় এই জনপদের সকল স্তরে অন্ধকার নেমে এসেছে। বর্তমান সরকার অসাধু সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের এই জাল ছিন্ন করে পুনরায় চিনিকলটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে চালু করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা খুবই বাস্তবসম্মত। আমরা একে স্বাগত জানাই।
মিলস গেট সাবজোনের আখচাষী ফেরদৌস আলম অভিযোগ করে বলেন, রংপুর চিনিকলের চাইতে অনেক কম মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন জয়পুরহাট চিনিকলের আখ জোন এলাকায় আখও উৎপাদন হয় কয়েক গুণ কম। তারপরও ওই মিলটি চালু রেখে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের রংপুর চিনিকলের আখ এবং ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের শ্যামপুর চিনিকলের আখ জয়পুরহাটে পরিবহণ করতে অতিরিক্ত ব্যয় করার মাধ্যমে এ শিল্পটি চিরতরে বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। বন্ধ চিনিকলগুলো পুনরায় চালুর বর্তমান সরকারের ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।
চিনিশিল্প রক্ষার পাশাপাশি বন্যা-ভাঙ্গনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত অভাবী জনপদ গাইবান্ধার মানুষকে বাঁচাতে এই চিনিকলসহ বন্ধ সকল চিনিকল দ্রুত চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন এই এলাকার কৃষক ও শ্রমিক-কর্মচারীসহ সকল স্তরের মানুষ। তারা আশা করছেন, অন্ধকার কাটিয়ে আবার আলোয় আলোকিত হয়ে চালু হবে ঐতিহ্যবাহী ও জেলার একমাত্র কৃষিভিত্তিক এ ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানটি।
বিজয় দিবসের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পোস্টে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করেছে। এ বিতর্কিত পোস্টকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) মোদির বিতর্কিত পোস্টের প্রতিবাদে এক বিবৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
‘ইতিহাসের তথ্য’ শিরোনামে বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দেওয়া বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানায়, দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ৯ মাসব্যাপী নৃশংস যুদ্ধ সহ্য করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ‘লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড : ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশন্স’ শিরোনামে তার বইয়ে, প্রাক্তন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব, কূটনীতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রয়াত জেএন দীক্ষিত লিখেছেন, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতীয় সামরিক হাইকমান্ডের একটি বড় রাজনৈতিক ভুল ছিল যৌথ কমান্ডের বাংলাদেশ পক্ষের কমান্ডার জেনারেল এমএজি ওসমানির উপস্থিতি নিশ্চিত এবং স্বাক্ষরকারী করতে ব্যর্থতা।
‘তার অনুপস্থিতির আনুষ্ঠানিক অজুহাত ছিল যে তার হেলিকপ্টারটি উড্ডয়ন করেছিল কিন্তু আত্মসমর্পণের সময়সূচির অনুযায়ী সময়মতো ঢাকায় পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু ব্যাপক সন্দেহ ছিল যে তার হেলিকপ্টারটি ভুল পথে পাঠানো হয়েছিল যাতে তিনি সময়মতো ঢাকায় পৌঁছাতে না পারেন এবং অনুষ্ঠানে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ভারতীয় সামরিক কমান্ডারদের ওপর নিবদ্ধ হয়। এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক বিচ্যুতি ছিল যা ভারত এড়াতে পারতো। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানির উপস্থিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম দিনগুলোতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এমন অনেক রাজনৈতিক ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে সাহায্য করতে পারতো।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা ১৯৭১ সালে আমাদের গৌরবময় বিজয় উদযাপন করি, আমরা সত্য উদযাপন করি।
এর আগে, ১৬ ডিসেম্বর নরেন্দ্র মোদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও এক্স হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লিখেন, আজ, বিজয় দিবসে, ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রাখা সাহসী সেনাদের সাহস ও আত্মত্যাগকে আমরা সম্মান জানাই। তাদের নিঃস্বার্থ আত্মোৎসর্গ ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে রক্ষা করেছে এবং আমাদের গৌরব এনে দিয়েছে। এই দিনটি তাদের অসাধারণ বীরত্ব ও অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাদের আত্মত্যাগ চিরকাল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।
পোস্টটিতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে গিয়ে একাত্তরের বিজয়কে কেবল ‘ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়’ বলা হয়েছে। যা বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষকে আহত করেছে।