মদ্যপান ও মাদক বহুমাত্রিক অপরাধের উৎস
ইসলামী শরিয়তের উদ্দেশ্য
ইসলামী বিধানের দর্শনকে ‘মাকাসিদে শরিয়া’ বা শরিয়তের উদ্দেশ্যাবলি নামে অভিহিত করা। শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো পাঁচটি। যথা: জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা, বংশ রক্ষা, বিশ্বাস বা ধর্ম রক্ষা। হত্যার পরিবর্তে হত্যা জীবন সুরক্ষার জন্য। সেখানেও রয়েছে দিয়াত বা রক্তপণ দিয়ে নিহতের অলি ওয়ারিস বা অভিভাবকদের কাছ থেকে ক্ষমা নেওয়ার সুযোগ। চুরির দায়ে হাত কাটা সম্পদ সুরক্ষার জন্য। এখানেও রয়েছে অপেশাদার অভাবীদের জন্য রয়েছে বিকল্প ব্যবস্থা ও ক্ষমার সুযোগ। সব ধরনের মাদক বা নেশা দ্রব্য হারাম বা নিষিদ্ধ, এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান জ্ঞান বা বুদ্ধি বিবেক সুরক্ষার জন্য। কারণ মানুষের ‘আকল’ বা সুষ্ঠু স্বাভাবিক জ্ঞান সুরক্ষিত না হলে, সে নিজের, পরিবারের, দেশ জাতি ও রাষ্ট্রের সবার ক্ষতি করবে। নারী-পুরুষের বৈবাহিক সূত্রে পবিত্র বন্ধন বংশগতি সুরক্ষার জন্য। তা না হলে, মানুষ আর ইতর প্রাণীর প্রভেদ থাকবে না। মানুষের মূল্যবোধ সংরক্ষিত থাকবে না। বিশ্বাস ও ধর্ম এটি ব্যক্তির নিজ জ্ঞানের বিষয়; তাই এর রক্ষা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বেও সুরক্ষা। সুতরাং ইসলাম সকল ধর্ম বিশ্বাসীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং কারো বিশ্বাসে আঘাত দেওয়াকে এখতিয়ার বহির্ভুত গণ্য করে।
মাদক পাপের আকর
ইসলামের মৌলিক পাঁচটি নিষিদ্ধ কাজের অন্যতম হলো নেশা বা মাদক দ্রব্য। এর মধ্যে মাদক ছাড়া অন্য চারটি অপরাধ নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে; অর্থাৎ ইচ্ছা করলে তা ছাড়া যায়। কিন্তু মাদক গ্রহণ এমন এক অপরাধ যা নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না; বরং সে নিজেই মাদক বা নেশার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে চাইলেই যখন তখন সেখান থেকে বের হয়ে আসা যায় না; অর্থাৎ সময়ে সে নেশাকে ছাড়তে চাইলেও নেশা তাকে সহজে ছাড়ে না বা ছাড়তে চায় না। মূল পঞ্চ নিষেধের চারটি অপরাধ পরিত্যাগ করে তওবা করে পবিত্র জীবন যাপন করা সম্ভব; কিন্তু নেশা বা মাদকাসক্ত ব্যক্তি তাওবা করারও সুযোগ পায় না এবং মাদক না ছেড়ে তাওবা করলেও তা কবুল হয় না। মৌল পাঁচটি নিষিদ্ধ কাজের চারটি হলো স্বতন্ত্র বা একক অপরাধ; কিন্তু মাদক হলো অপরাধের আকর। কুরআন কারীমে বর্ণিত হারূত ও মারূত এই মাদকের নেশায় মাতাল হয়েই যুহরার ইশারায় খুনখারাবিসহ নানান অপরাধে লিপ্ত হয়েছিলো। (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১০২; তাফসীরে আযীযী ও তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন)।
সকল মাদক অপবিত্র ও হারাম
যে সকল বস্তু ব্যবহারে নেশার উদ্রেক হয়, মানুষের মস্তিষ্ক বিকল হয়, স্বাভাবিক জ্ঞান ঠিকভাবে কাজ করে না; সেসকল বস্তুই মাদক। মানবতার সুরক্ষার জন্য ইসলামে মাদক সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ অপবিত্র ও হারাম। হজরত আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘যে সকল পানীয় নেশা সৃষ্টি করে, তা হারাম।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পবিত্রতা অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ১৬৯, হাদীস: ২৪১, পৃষ্ঠা: ১৪০)। নেশাকর ও উত্তেজক ড্রাগ, যথা: মদ, গাঁজা বা গাঞ্জা, ভাং, আফিম, হেরোইন, ইয়াবা, ফেন্সিডিল, স্পিরিট, ঘুমের ঔষধ, সলুশন ইত্যাদি সেবনে বুদ্ধি নাশ ঘটায়, জ্ঞান লোপ পায়, মাতাল হয়ে পাগল প্রায় হয়ে যায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আত্মমর্যাদা বোধ থাকে না এবং লজ্জাও থাকে না। হাদিস শরিফে আছে: ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। যার লজ্জা নেই তার ঈমান নেই।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ৩, হাদীস: ৮, পৃষ্ঠা: ১৭)।
আল কুরআনে মাদক নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ
মাদক নিষিদ্ধের বিষয়ে কুরআন কারীমে তিনটি পর্বে এসেছে। প্রথমে বলা হয়েছে: ‘লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও; কিন্তু এগুলোর পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ২১৯)।
দ্বিতীয় ধাপে বলা হলো: ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্যনির্ণায়ক শর ঘৃণ্যবস্তু, শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সূরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯০)।
চূড়ান্ত পর্যায়ে বললেন: ‘শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদিগকে আল্লাহর স্মরণে ও সলাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সূরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯১)।
মাদকের প্রসার কিয়ামত বা ধ্বংসের পূর্বলক্ষণ
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘কিয়ামতের কিছু নিদর্শন হলো- ইলম লোপ পাবে, অজ্ঞানতার বিস্তার ঘটবে, মদ্যপান ও মাদকের প্রসার ব্যাপক হবে, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, ইলম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ৬২, হাদীস: ৮০, পৃষ্ঠা: ৬৪)।
ইসলামী শরিয়তে মাদকের ফিকহী বিধান
ইসলামী ফিকাহ বা ব্যবহারিক বিধান মতে, মাদক হারাম বা নিষিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি তা অপবিত্র। কোনো মুসলমান মাদক ব্যবহার করা যেমন হারাম, অনুরূপভাবে তা সংগ্রহ করা, সংরক্ষণ করা ও বিতরণ করা এবং ক্রয় ও বিক্রয় করা সর্বোতভাবে সম্পূর্ণরূপে হারাম অবৈধ নিষিদ্ধ তথা কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। প্রাণীর মল-মূত্র হারাম এবং অপবিত্র হলেও তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার এবং ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ বা বৈধ। এগুলো সম্পদ হিসেবেও বিবেচিত এবং এসবের ক্ষয়-ক্ষতিতেও ক্ষতিপূরণ প্রযোজ্য। তবে শূকর ও মাদক অমুসলিমদের জন্য সম্পদ হলেও মুসলমানের জন্য সম্পদই নয়; মুসলমানের কাছে সংরক্ষিত এ উভয় বস্তুর ক্ষতি সাধন করলে, এর জন্য বিচার বা প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ প্রযোজ্য নয়। সুতরাং সকল প্রকার মাদক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ এবং ক্রয় বিক্রয় ও এর সাথে যে কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতা নাজায়েজ ও হারাম। (আল ফিকহুল ইসলামী)।
মদ ও মাদক হারামের সাথে সাথে মদের পাত্র পর্যন্ত অন্য কাজে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ ও হারাম। হাদীস শরিফে রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবীআহ গোত্রের প্রতিনিধিদের চারটি কাজের নির্দেশ দিলেন এবং চারটি কাজ বারণ করলেন। আল্লাহর উপর ঈমান আনা (এক আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত রসূল), সলাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা এবং রমাদান মাসে সিয়াম পালন করা; গনীমাতের একপঞ্চমাংশ দান করা। নিষেধ করলেন: (মদপাত্র হিসেবে ব্যবহৃত) শুকনো লাউয়ের খোল, সবুজ কলস এবং আলকাতরার পলিশকৃত পাত্র ব্যবহার। (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, ইলম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ৬৭, হাদীস: ৮৭, পৃষ্ঠা: ৬৭-৬৮)।
মাদক সেবনে পরকালে ভয়াবহ পরিণতি
মিরাজের রজনীতে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি দেখানো হলো। ‘তিনি মদ মাদক ও নেশাগ্রহণকারীদের শাস্তি দেখলেন। তারা জাহান্নামীদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মালিক নামে জাহান্নামের রক্ষী ফেরেশতাকে দেখলেন। সে মলিন মুখ, হাঁসি নেই, বলা হলো জাহান্নাম সৃষ্টির পর থেকে সে কখনো হাঁসেনি। (বুখারী ও মুসলিম, মিরাজ অধ্যায়)।
মাদকসেবী শবে বরাতে এবং শবে কদরেও ক্ষমা পায় না ও দোয়া কবুল হয় না: হযরত আবূ সালাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত (শবে বরাত) আসে তখন আল্লাহ তাআলা মাখলূকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদিগকে ক্ষমা করে দেন, কাফিরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং মদ্যপায়ীদের মদ্যপান পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না। (কিতাবুস সুন্নাহ, শুআবুল ঈমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।
রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে রয়েছে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর। যে রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে। যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (সূরা-৯৭ কদর, আয়াত: ১-৫)। এ রাতে সন্ধ্যা লগ্নে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন: কে আছো ক্ষমা প্রার্থী? আমি ক্ষমা করে দেবো। এভাবে সকাল পর্যন্ত ডেকে ডেকে ক্ষমা করতে থাকেন। কিন্তু এ পবিত্র ও মহিমান্বিত কদরের রাতেও আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে যে পাঁচ প্রকার লোক বঞ্চিত থাকবে তাদের মধ্যে প্রথম হলো মদ্যপায়ী ও মাদকসেবীরা। (নাঊযু বিল্লাহ)। ঐ পাঁচ প্রকার লোক হলো: মদ্যপায়ী বা মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী, মাতা পিতার অবাধ্য সন্তান, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, ইচ্ছাকৃত নামাজ তরককারী, বিনা কারণে অপর মুসলমান ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা; তাফসীরে কাশফুল আসরার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৬৪)।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, শেখ ছাদী (র.) ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
এসএ/