মি’রাজ মহানবী (স.) এর ঊর্ধ্বজগত ভ্রমণ
মি’রাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। পরিভাষায় মিরাজ হলো, মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাঈল (আ.) ও হযরত মীকাঈল (আ.) সমবিব্যাহারে বুরাক বাহন মাধ্যমে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে, প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আযীম পর্যন্ত ভ্রমণ; মহান রব্বুল আলামীনের সাথে দীদার লাভ ও জান্নাত জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসা।
মি’রাজের একটা অংশ হলো ইসরা। ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। যেহেতু নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মি’রাজ রাত্রিকালে হয়েছিলো তাই এটিকে ইসরা বলা হয়। বিশেষত বাইতুল্লাহ শরীফ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফরকে ইসরা বলা হয়ে থাকে। কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তিনি পবিত্র (আল্লাহ) যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আসপাশ আমি বরকতময় করেছি। যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনিই সর্বস্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা-১৭ ইসরা- বনী ইসরাঈল, আয়াত: ১)।
মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিলো নবুওয়াতের এগারোতম বছর সাতাইশ রজব। তখন নবীজির বয়স একান্ন বছর। এবছর নবীজির চাচা আবুতালিব মৃত্যু বরণ করেন এবং আবু তালিবের মৃত্যুর একসপ্তাহের মধ্যে নবীজির সহধর্মিনী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা.) এর ওফাত হয়। ঘরে বাইরে এদু’জন নবীজির অতি প্রিয় ও জীবনের বড় অবলম্বন ছিলেন। একই বছর প্রধান দুই প্রিয়ভাজন ও অবলম্বন হারিয়ে নবীজি খুবই বিচলিত হন। তাই এবছরকে আমুল হুযন বা দুশ্চিন্তার বছর বলা হয়। প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে শান্তনা দেওয়ার জন্য ও স্বীয় রহস্যলোক দেখানোর জন্য আল্লাহ তাআলা স্বীয় হাবীবকে মি’রাজে নিয়ে যান।
মি’রাজ হয়েছিলো সশরীরে জাগ্রত অবস্থায়। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাস। যদি আধ্যাত্মিক বা রূহানীভাবে অথবা স্বপ যোগে হওয়া কথা বলা হতো, তাহলে তাদের অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিলো না। মি’রাজের বিবরণ কোরআন কারীমে সূরা নাজমে সূরা ইসরায় বিবৃত হয়েছে। হাদীস শরীফে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও সিহাহ সিত্তাসহ অন্যান্য কিতাবে এই ইসরা ও মি’রাজের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ সূত্রে সবিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “শপথ নক্ষত্রের যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথী (মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি। আর তিনি মনখোদ কথা লেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা প্রদত্ত ওহী (ভিন্ন অন্য কিছু) নয়। তাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাঈল আ.)। সে (জিবরাঈল আ.) পাখাবিশিষ্ট, সে স্থিত হয়েছে দূর উর্ধে। অতপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করলো। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরো নিকট। পুনরায় তিনি ওহী করলেন তাঁর বান্দার প্রতি যা তিনি ওহী করেছেন। ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছো তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; ছিদরাতুল মুন্তাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকেগেলো ছিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ।” (সূরা-৫৩ নাজম, আয়াত: ১-১৮)।
মি’রাজ সফরে যাঁদের সাথে দেখা হলো:
প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরীস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারূন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মূসা (আ.), সপ্তম আসমানে হজরত ইব্রাহীম (আ.)। প্রত্যেকের সাথে সালাম কালাম ও কুশল বিনিময় হয়েছে। তিনি বাইতুল মামুর গেলেন, যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা আসেন ও প্রস্থান করেন; তারা দ্বিতীয়বার আসার সুযোগ পান না। অতঃপর সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে গেলেন। সেখানে চারটি নদী দেখলেন; দুটি প্রকাশ্য ও দুটি অপ্রকাশ্য। অপ্রকাশ্য দুটি নদী জান্নাতের আর প্রকাশ্য নদী দুটি হলো নীল ও ফোরাত। তারপর বাইতুল মামুরে পৌঁছলে এক পেয়ালা শরাব, এক পেয়ালা দুধ ও এক পেয়ালা মধু পেশ করা হলো। তিনি (স.) দুধ পান করলেন, এটাই স¦ভাব সুলভ (ইসলাম)। (বুখারী শরীফ: ৩৬৭৪, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৫৪৮-৫৫০)।
মি’রাজের সিদ্ধান্তাবলী:
মি’রা রজনীতে হাবীব ও মাহবূবের এ একান্ত সাক্ষাতে চৌদ্দটি বিষয় ঘোষণা হয়েছে। যথা: (১) আল্লাহকে তাঁকে ছাড়া কারো ইবাদাত করবে না, (২) পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যাবহার করবে, (৩) নিকট স্বজনদের তাদের অধিকার দাও; (৪) মিসকীনদের ও পথসন্তানদের (তাদের অধিকার দাও); (৫) অপচয় করো না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই, (৬) কৃপণতা করো না, (৭) সন্তানদের হত্যা করবে না, (৮) ব্যভিচারের নিকটেও যেয়ো না, (৯) মানব হত্যা করো না, (১০) এতিমের সম্পদের কাছেও যেয়ো না, (১১) প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো, (১২) মাপে পূর্ণ দাও, (১৩) অবস্থান করো না যাতে তোমার জ্ঞান নেই, (১৪) পৃথিবীতে গর্বভরে চলো না। এসবই মন্দ, তোমার রবের কাছে অপছন্দ। (সূরা-১৭ ইসরা- বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২২-৪৪,)। নবীজি (স.) জান্নাত জাহান্নামও পরিদর্শন করেছেন।
কি পাপে, কি শাস্তি?
বেনামাজীর শাস্তি দেখলেন, বড় পাথর দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হচ্ছে, আঘাতে মাথা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, পুনরায় ভালো হয়ে যাচ্ছে, আবার আঘাত করা হচ্ছে।
জাকাত না দেওয়ার শাস্তি দেখলেন। তাদের সমুখে ও পশ্চাতে পাওণাদারেরা থাকবে। তারা পশুবৎ চরবে এবং নোংরা আর্জনা ময়লা ও পুঁজ এবং কাঁটাযুক্ত আঠালো বিষাক্ত ফল, জাহান্নামের উত্তপ্ত পাথর ভক্ষণ করবে।
এই উম্মতের চোগলখোরের শাস্তি দেখলেন, তাদের পাশ্বদেশ হতে গোস্ত কেটে তাদের খাওয়ানো হচ্ছে; আর বলা হচ্ছে, যেভাবে তোমার ভাইয়ের গোস্ত খেতে সেভাবে এটা ভক্ষণ করো। অনুরূপ দেখলেন গীবতকারীদের শাস্তি। তাদের অগ্নময় লোহার নখর দিয়ে তারা তাদের চেহারা ও বক্ষ বিদীর্ণ করছে। বললেন, হে জিবরীল! (আ.) এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হলো সেসব লোক যারা পশ্চাতে মানুষের গোস্ত খেতো (আড়ালে সমালোচনা করতো)।
দেখলেন সুদখোরদের বড় বড় পেট, যার কারণে তারা তাদের অবস্থান থেকে নড়াচড়া করতে পারছে না। তাদের সাথে রয়েছে ফেরাউন সম্প্রদায়, তাদেরকে অগ্নিতে প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে।
জেনাকার বদকার নারী, যারা ব্যভিচার করেছে এবং ভ্রুণ ও সন্তান হত্যা করেছে, তাদের দেখলেন স্তনদ্বয়ে আংটা লাগিয়ে কাউকে পায়ে আংটা লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে; তারা অর্তচিৎকার করছে।
ব্যভিচারী জেনাকার পুরুষের শাস্তি দেখলেন। এক সম্প্রদায় তাদের সামনে একটি উত্তম পাত্রে উপাদেয় তাজা ভূনা গোস্ত এবং অন্য নোংরা একটি পাত্রে পঁচা মাংস। তারা উত্তম পাত্রের উন্নত তাজা সুস্বাদু গোস্ত রেখে নোংরা পাত্রের পঁচা মাংস ভক্ষণ করছে। বললেন, হে জিবরীল! (আ.) এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হলো ঐসব পুরুষ যারা স্বীয় বৈধ স্ত্রী রেখে অন্য নারী গমন করেছে এবং ঐসব নারী যারা স্বীয় বৈধ স্বামী রেখে পর পুরুষ গামিনী হয়েছে।
দেখলেন এক লোক বিশাল লাকড়ির বোঝা একত্র করেছে, যা সে উঠাতে পারছে না; কিন্তু আরো লাকড়ি তাতে বৃদ্ধি করছে। বললেন, হে জিবরীল! (আ.) এটা কি? তিনি বললেন, এ হলো আপনাপর উম্মতের সে ব্যক্তি যে মানুষের আমানত আদায় করেনি; বরং আরো অধিক গ্রহণ করেছে।
দেখলেন অশ্লীল বাক্য ব্যবহারকারী ফেতনা সৃষ্টিকারীদের শাস্তি। তাদের জিহবা ও ঠোঁট লোহার কাঁচি দ্বারা কর্তন করা হচ্ছে, পুনরায় তা পূর্বানুরূপ হয়ে যাচ্ছে এবং আবার কাটা হচ্ছে; এভাবেই চলছে।
দেখলেন ছোট্ট একটি পাথর হতে বিশাল এক ষাঁড় বের হলো; পুনরায় ঐ ষাঁড় সে পাথরের ভিতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিলো; কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছিলো না। বললেন, হে জিবরীল! (আ.) এটা কি? তিনি বললেন, এটা হলো সেসব লোকের দৃষ্টান্ত যারা বড় বড় দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলে লজ্জিত হয়, পরে আর তা ফিরিয়ে নিতে পারে না। এতিমের সম্পদ আত্মসাতকারীদের দেখলেন। তাদের ওষ্ঠ অধর যেনো উঠের ঠোঁটের মতো। তাদের মুখে আগুনের জ্বলন্ত কয়লা প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে এবং তা তাদের পায়ূপথ দিয়ে বের হয়ে আসছে।
মদ মাদক ও নেশা গ্রহণকারীদের শাস্তি দেখলেন। তারা জাহান্নামীদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে। অনুরূপ তিনি দেখলেন ফেরাউন কন্যা মাশতা এর সমাধি। সেখানে পেলেন সুবাতাস। বললেন, হে জিবরীল! (আ.) এ সুঘ্রাণ কিসের? বললেন, এহলো ফেরাউন কন্যা মাশতা ও তার সন্তানদের সুঘ্রাণ।
নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মালিক নামে জাহান্নামের রক্ষী ফেরেশতাকে দেখলেন। সে মলিন মুখ, হাঁসি নেই, বলা হলো জাহান্নাম সৃষ্টির পর থেকে সে কখনো হাঁসে না। (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি: শেখ ছাদী (র.) ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
E-Mail: smusmangonee@gmail.com, usmangonee9@gmail.com