মাতৃভাষা আল্লাহর সেরা দান
ভাষা ও বর্ণবৈচিত্র আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন:
ভাষা আল্লাহর দান, আল্লাহ তাআলার সেরা নেয়ামত। মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। ভাষা মনুষ্য পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট। প্রাণীকুল ও পশুসমাজ থেকে স্বাতন্ত্রের মোক্ষ উপাদান হলো ভাষা। মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম সকল ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়; কারণ সকল ভাষাই আল্লাহর দান ও তার কুদরতের নিদর্শন।
কুরআন কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন: 'আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে- আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে। (সূরা-৩০ রূম, আয়াত: ২২)।
ভাষা মানুষ ও প্রাণীর প্রভেদ:
আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হলো মানুষ। মানুষ ও অন্য সকল প্রাণী এবং জীবজন্তুর মাঝে দৃশ্যমান পার্থক্য হলো, মানুষ সবাক; অন্য জীবজন্তু ও প্রাণী নির্বাক। মানুষ ভাষা দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে এবং একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। অন্য প্রাণী তা করতে পারে না। মানুষের পরিচয় বা সংজ্ঞায় আরবিতে বলা হয়, ‘হায়ওয়ানুন নাতিক’ অর্থাৎ ‘বাকশক্তিসম্পন্ন প্রাণী’। আপাত দৃষ্টিতে মানুষ ও প্রাণী তথা পশুর মাঝে বাহ্যিক পার্থক্য হলো বাক বা ভাষা।
ভাষা বা বর্ণে নয় কর্মেই পরিচয়:
সকল মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। সকলেরই পিতা বাবা আদম আলাইহিস সালাম, সকলেরই মাতা হাওয়া আলাইহাস সালাম। সাদা কালো, লম্বা খাটো সে তো আল্লাহর সৃষ্টি প্রকৃতির অবদান। বর্ণ বৈষম্য, ভাষা বৈষম্য এবং ভৌগলিক ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না।
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন: “হে মানুষ! আমি তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে
তোমাদিগকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সহিত পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। (সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।
সকল নবী-রসূলগণ স্বজাতির ভাষাভাষী ছিলেন:
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তিন কারণে তোমরা আরবিকে ভালোবাস; যেহেতু আমি আরবি, কুরআন আরবি এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি। (বুখারী)।
কিন্তু আরবি পরকালের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও সকল নবী রসূলগণ আরবি ভাষাভাষী ছিলেন না; এমন কি সকল আসমানী
কিতাবও আরবি ভাষায় ছিল না। আমরা জানি- তাওরাত কিতাব ইবরানী ভাষায় হযরত মূসা (আ.) এর উপর নাযিল করা হয়; যাবূর কিতাব ইউনানী ভাষায় হযরত দাঊদ (আ.) এর উপর নাযিল করা হয়; ইনজিল কিতাব সুরিয়ানী ভাষায় হযরত ঈসা (আ.) এর উপর নাযিল করা হয়; এবং সর্বশেষ আসমানী কিতাব ফুরকান বা কুরআন আরবি ভাষায় সর্বশেষ নবী ও রসূল হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি নাযিল করা।
বিদায় হজ্জের ভাষণে নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরেছেন: ‘কালোর উপর সাদার প্রাধান্য
নেই, অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারী শরীফ)।
সুতরাং কোনো ভাষাকে হেয় জ্ঞান করার অবকাশ নেই, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই ও অবহেলা করার অধিকার নেই; কেননা ভাষার স্রষ্টা মহান আল্লাহ। তার সৃষ্টির অবমূল্যায়ন করা তার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর। আল্লাহ তায়ালা বলেন: 'আমি প্রত্যেক রসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য'। (সূরা-১৪ ইবরাহীম,
আয়াত: ৪)।
মহাগ্রন্থ আল কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল করার কারণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং ব্যাখ্যা প্রদান করেন এভাবে: 'ইহা আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কুরআন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।' (সূরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ২)।
আরবদের কাছে আরবি কিতাব আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে কারণ তাদের মাতৃভাষা আরবি; অনারবি ভাষায় নাযিল করলে তাদের বুঝতে এবং অনুসরণ করতে অসুবিধা হতো। ধর্মীয় দিক থেকে বিবেচনা করলে ঐতিহ্যগত কারণে কুরআনও প্রাচীন হিব্রু বা সুরইয়ানী ভাষায় অবতীর্ণ হওয়ারই কথা।
কিন্তু ইসলাম শুধু ঐতিহ্য রক্ষার সার্থে ব্যাপক জাতীয় কল্যাণ বাধাগ্রস্ত হতে দেয়নি। বরং যাযাবর আরবদের স্থানীয় ভাষাতে কুরআন নাযিল করে বিশ্বকল্যাণ নিশ্চিত করেছেন।
ভাষার বিশুদ্ধতা সুন্নাত: শুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর বর্ণনার প্রভাব অনস্বীকার্য। আমাদের প্রিয় রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন
‘আফছাহুল আরব’ তথা আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধ ভাষী। সুতরাং বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ‘ওয়া ইন্না মিনাল বায়ানি লা ছিহরুন’ অর্থাৎ কিছু বর্ণনায় রয়েছে যাদুর ছোঁয়া। (আন নাহজুল বালাগাহ)।
কুরআনুল কারিমের বর্ণনা: 'দয়াময় রহমান আল্লাহ! কুরআন পাঠ শেখালেন; মনুষ্য সৃজন করলেন; তাকে ভাষা বয়ান শিক্ষা দিলেন।' (সূরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ১-৪)।
ভাষা চর্চা ইবাদাত। আরবি ভাষার ব্যাকরণ মুসলমানদের হাতেই রচিত হয়। অনারবরা কুরআন পড়তে সমস্যা হতো বিধায় হযরত আলী (রা.) তার প্রিয় শাগরেদ হযরত আবুল আসওয়াদ দুওয়াইলী (র.) কে নির্দেশনা দিয়ে আরবি ভাষাশাস্ত্র প্রণয়ন করান। যা ইলমে নাহু ও ইলমে ছরফ নামে পরিচিত। পরবর্তিতে উচ্চতর ভাষাতত্ত্ব ইলমে বায়ান, ইলমে মাআনী ও ইলমে বাদী‘র উন্নয়ন ঘটে; যার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইমাম আবদুল কাহির যুরজানী (র.) ও ইমাম যামাখশারী (র.)। এ ছাড়াও বসরায় ইমাম ফার্রা (র.) ও ইমাম কেছায়ী (র.) এবং ক‚ফায় ইমাম খলীল (র.), ইমাম আখফাশ (র.) ও ইমাম ছিবাওয়াইহ (র.) বিখ্যাত ছিলেন। শেখ আবদুর রহমান জামী (র.) পারস্যবাসী হয়েও বিশ্বের সেরা আরবি ব্যাকরণের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গ্রন্থ ‘শারহে জামী’ (ফাওয়ায়িদে যিয়াইয়া) রচনা করেন। যা ‘শাফিয়া’ গ্রন্থের প্রণেতা ইমাম ইবনে হাজিব (র.) প্রণীত ‘কাফিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা। এ গন্থের আরও জগৎ বিখ্যাত বিশ্লষণ পুস্তক রয়েছে; ‘সুওয়ালে কাবুলী, সুওয়ালে বাসুলী, তাহরীরে চম্বট ইত্যাদি এর অন্যতম।
সাহিত্য চর্চাও ইবাদাত:
সুসাহিত্যও ইবাদাত। আল্লাহ তাআলা বলেন: '(হে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমি আপনার
প্রতি সর্বসুন্দর কাহিনী বর্ণনা করেছি।' (সূরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ২)।
প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে স্বয়ং কাব্য করতেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) কাব্য রচনা করতেন। হযরত আয়িশা (রা.) কাব্য চর্চা করতেন। এভাবে ইসলামের সকল যুগেই বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য চর্চা চলে আসছে। সত্য প্রচার ও দাওয়াতী কাজে ভাষার গুরুত্ব: আল্লাহ তাআলা মানুষের হিদায়াতের জন্য নবী রসূল (আ.) গণকে পাঠিয়েছেন। সকল নবী রসূল (আ.) গণের ধর্ম প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল দাওয়াত তথা মহা সত্যের প্রতি আহ্বান। আর এর জন্য ভাষার কোনো বিকল্প নাই। আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা (আ.) এর প্রতি ওহী নাযিল করলেন; তাকে নবী ও রসূল হিসেবে ঘোষণা করলেন; তার প্রতি তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ করেন, তখন তিনি তার ভাই হযরত হারূন (আ.) কে নবী ও রসূল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আল্লাহর সমীপে আরজ করলেন; তিনি ছিলেন বাগ্মী, শুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী সুবক্তা, আর মূসা (আ.) এর মুখে ছিল জড়তা। মুসা (আ.) কারণ হিসেবেও বলেছেন- ‘হওয়া আফছাহু মিন্নী’ অর্থাৎ সে আমার অপেক্ষা বাকপটু।
কুরআন কারিমে এই বর্ণনাটি এভাবে উপস্থাপিত হয়েছে: 'মূসা (আ.) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সীনা প্রশস্ত করে দিন। এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। আমার ভাষার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আমার জন্য একজন সহায্যকারী বানিয়ে দিন আমার স্বজনদের মধ্য হতে; আমার ভাই হারূনকে; তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন এবং তাকে আমার (দাওয়াতী) কাজের শরীকদার করুন, যাতে আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা বেশি বেশি বর্ণনা করতে পারি এবং আপনাকে অধিক
স্মরণ করতে পারি; আপনি তো আমাদের সর্বোত প্রত্যক্ষকারী।' (সূরা-২০ তহা, আয়াত: ২৫-৩৬)।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি: শেখ ছাদী (র.) ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
টিটি/