শীতকালের ইবাদাত ও আমলের বিধিবিধান
প্রাকৃতিক বৈচিত্র আল্লাহর দান। শীতকাল প্রকৃতির বিশেষ নেয়ামত। শীতকালের জন্য রয়েছে বেশ কিছু স্বতন্ত্র বিধিবিধান। আল্লাহ তায়ালা বলেন: 'আল্লাহ দিন ও রাতের আবর্তন ঘটান, নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।' (সূরা-২৪ নূর, আয়াত: ৪৪)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: 'আর তিনি দিবা-রাত্রিকে পরস্পরের অনুগামী করেছেন, যে উপদেশ গ্রহণ করতে চায় অথবা কৃতজ্ঞ হতে চায় তার জন্য।' (সূরা-২৫ ফুরকান, আয়াত: ৬২)। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘শীতকাল হলো ইবাদাতকারীদের জন্য গনীমতস্বরূপ।’ শীত তো এমন গনীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ), যা কোনো রক্তপাত কিংবা চেষ্টা ও কষ্ট ছাড়াই অর্জিত হয়। সবাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ গনীমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাভ করে এবং কোনো প্রচেষ্টা বা পরিশ্রম ব্যতীরেকে তা ভোগ করে।
শীলকাল নফল রোজা রাখর জন্য সুবর্ণকাল। কাজা রোজা বাকি থাকলে তা আদায় করার জন্যও শীতের দিন অতি উপযোগী। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেন, ‘শীতকাল হচ্ছে মুমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ)। বায়হাকীর বর্ণনায় রয়েছে, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে।’ শীতকাল এলে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন- ‘হে শীতকাল! তোমাকে স্বাগতম! শীতকালে বরকত নাজিল হয়; শীতকালে রাত দীর্ঘ হওয়ায় নামাজ আদায় করা যায় এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা যায়।’ হাসান বসরি (রহ.) বলেন- ‘শীতকাল মুমিনের জন্য কতই না উত্তম! রাত দীর্ঘ হওয়ায় নামাজ পড়া যায় এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা যায়।’
আমের ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (স.) বলেছেন, ‘শীতল গনীমত হচ্ছে শীতকালে রোজা রাখা।’ (তিরমিজি: ৭৯৫)। হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) এর মৃত্যুর সময় তাকে তার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন- ‘আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না; বরং (রোজার কারণে) গ্রীষ্মের দুপুরের তৃষ্ণা, শীতের রাতের নফল নামাজ এবং ইলমের আসরগুলোতে হাজির হয়ে আলেমদের সোহবত হারানোর জন্য আমি কাঁদছি।’
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন- ‘আমি কি তোমাদের শীতল গনীমত কি সেটা বলে দেব না?’ সাহাবীগণ বললেন অবশ্যই। তিনি বললেন, ‘সেটা হচ্ছে, শীতকালে দিনে রোজা রাখা ও রাতে নামাজ পড়া।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত আছে, ‘নবী কারীম (স.) বলেছেন, যদি কোনো তীব্র ঠান্ডার দিন আল্লাহর কোনো বান্দা বলে- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই), আজকের দিনটি কতই না শীতল! হে আল্লাহ! জাহান্নামের জামহারি থেকে আমাকে মুক্তি দিন।’ তখন আল্লাহ জাহান্নামকে বলেন- নিশ্চয়ই আমার এক বান্দা আমার কাছে তোমার জামহারি থেকে আশ্রয় চেয়েছে। আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাকে আশ্রয় দিলাম। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন- জামহারি কী? নবীজি (স.) বললেন, জামহারি এমন একটি ঘর যাতে অবিশ্বাসী অকৃতজ্ঞদের নিক্ষেপ করা হবে এবং এর ভিতরে তীব্র ঠান্ডার কারণে তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে। (আমালুল ইয়াওম ওয়াল লাইল: ৩০৬)।
শীতকালে সঠিকভাবে অজু করা, অজুর অঙ্গ ধোয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা; প্রতিটি অঙ্গের যতটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো দরকার ততটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আমল। রসূলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তিনটি আমল পাপমোচন করে, ‘সঙ্কটকালীন দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু।’ (আদ দোয়া লিত তাবরানী: ১৪১৪)। রসূলে আকরাম (স.) আরও বলেছেন, আমি কি তোমাদের জানাব না? কিসে তোমাদের পাপমোচন করবে! এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করবে! সাহাবায়ে কিরাম বললেন- অবশ্যই! হে আল্লাহর রসূল (স.)! তিনি বললেন, ‘শীতের কষ্ট সত্ত্বেও ঠিকভাবে অজু করা।’ (মুসলিম: ২৫১; তাফসীরে কুরতুবী)।
অজুর ক্ষেত্রে পা না ধুয়ে মোজার উপর মাসেহ করার বিধানও রয়েছে। ‘মুসাফির’ (ভ্রমণরত) ব্যক্তি তিন দিন তিন রাত (৭২ ঘণ্টা) পর্যন্ত মাসেহ করে যেতে পারবেন এবং ‘মুকীম’ (সবাসে অবস্থানরত) ব্যক্তি এক দিন এক রাত (২৪ ঘণ্টা) মাসেহ করতে পারবেন। এ সময়সীমার পর অজুর প্রয়োজন হলে মোজা খুলে পা ধুয়ে অজু করতে হবে। অধিকাংশ মুজতাহিদ ফকীহ শুধু চামড়ার মোজার ওপর মাসেহ করাই অনুমোদন করেন। হজরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বর্ণনা করেন, রসূল (স.) কাপড়ের মোজা (জাওরাবাঈন) এবং জুতার উপরও মাসেহ করেছেন। (তিরমিজি: ৯৯; আবু দাউদ: ১৫৯)। এ হাদীসের ভিত্তিতে অন্যান্য মুজতাহিদ ফকীহগণ কাপড়ের মোজা ও পুরো পায়ের পাতা আবৃতকারী জুতার উপর মাসেহ করা অনুমোদন করেন।
প্রচন্ড শীতে কষ্ট হলে গরম পানি দিয়ে অজু করাতে কোনো বাধা নেই। অজুর পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মুছে ফেলাতেও সমস্যা নেই। শীতের তীব্রতা যদি কারও সহ্যের বাইরে চলে যায়, পানি গরম করে ব্যবহার করার সুযোগ না থাকে এবং ঠান্ডা পানি ব্যবহারে শারীরিকভাবে ক্ষতি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তিনি অজু বা গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করতে পারেন। (বায়হাকি, খন্ড: ১, হাদীস: ২২৬)।
শীতকালে গরম পোশাক পরিধান করা সুন্নাত। ওমর (রা.) তার শাসনামলে শীতের আগমন লগ্নে লিখতেন- ‘শীত কিন্তু এসে গেল, এ তোমাদের দেহের শত্রু। অতএব এর প্রতিরোধে পশমী বস্ত্র, মোজা, হাতমোজা ইত্যাদির প্রস্তুতি নাও। আর পশম দিয়ে গায়ের চামড়ায় এবং শরীরের পোশাকে শীতের আক্রমণ ঠেকাও। কারণ শীত খুব দ্রুত প্রবেশ করে, তবে সহজে বিদায় নেয় না।’
নেককার পুণ্যাত্মাগণ শীতের রাতগুলোয় সালাত ও জিকিরে রত হন। শীতকাল আগমন করলে উবাঈদ বিন উমাঈর (রা.) বলতেন- ‘হে কুরআনের ধারক! তোমাদের রাতগুলো তিলাওয়াতের জন্য প্রলম্বিত করা হয়েছে, অতএব তা পড়তে থাকো। আর রোজা রাখার জন্য তোমাদের দিনগুলো সংক্ষেপিত করা হয়েছে, তাই বেশি বেশি রোজা রাখো।’ কুরআনের ভাষায়, 'তারা রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটায়, আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকে।' (সূরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৭-১৮)।
হজরত ওমর (রা.) তার ছেলেকে উদ্দেশ করে বলেন- ‘শীতের দিনে ভালোভাবে অজু করা বড় গুরুত্বপূর্ণ ও সওয়াবের কাজ।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (স.) বলেন- ‘আমি কি তোমাদের এমন কাজের কথা বলব না! যা দ্বারা গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি হয়?’ সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, ‘মন না চাইলেও অজু করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।’ (মুসলিম)।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, শেখ ছাদী (র.) ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
টিটি/