রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত
ইসলামের মৌল শিক্ষার মধ্যে, ঈমান, নামাজ ও যাকাতের পরেই রোজার স্থান। অতএব রোজা ইসলামের চতুর্থ রোকন। রোজা ফারসি শব্দ। আরবিতে একে সিয়াম বলা হয়। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। আর ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদেকের সময় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন ক্রিয়া হতে বিরত থাকার নাম সিয়াম ও রোজা। মানুষের শরীর একটা বৃহৎ যন্ত্র বিশেষ। এর মধ্যে বহু কল-কব্জা রয়েছে, ধাতু নির্মিত নির্জীব যন্ত্রেরও বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। নিয়মিত বিশ্রামের ব্যবস্থা না থাকলে এটি বিকল হয়ে যায়। মানবদেহরূপী যন্ত্রের ক্ষেত্রেও এই কথা একইভাবে প্রযোজ্য। পাকস্থলী, মূত্রাশয়, হৃৎপিণ্ড, যকৃত ইত্যাদি যন্ত্রাংশসমূহেরও রীতিমতো বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। পানাহার ও যৌন ক্রিয়াদি হতে বিরত থেকেই দেহযন্ত্রকে বিশ্রাম দেওয়া হয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কালামে পাকে এরশাদ করেছেন, “হে বিশ্বিবাসীগণ। তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল।” বিশ্বনবীর আবির্ভাবের আগে সকল পয়গম্বর-উম্মতের জন্যেই রোজার বিধান ছিল। এ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য সব ধর্মেই উপবাসের বিধান আছে। তবে অন্যান্য ধর্মের উপবাস এবং ইসলামের রোজার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
“রামাদান মাস যখন আগমন করে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানদের শৃঙ্খলাবন্ধ করা হয়।”২ (বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭২, ৩/১১৯৪; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৫৮)
“তোমাদের নিকট রামাদান মাস এসেছে। এই মাসটি বরকতময়। আল্লাহ তোমাদের উপর এই মাসের সিয়াম ফরজ করেছেন। এই মাসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই মাসে দুর্বিনীত শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়। এই মাসে এমন একটি রাত আছে যা এক হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি সেই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতভাগা।”৩ (নাসাঈ, আস-সুনান ৪/১২৯; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৪১)
সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর সিয়াম লিপিবদ্ধ (ফরজ) করা হয়েছে, যেরূপভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।”৪ (সূরা বাকারা: ১৮৩ আয়াত)
আমরা দেখেছি, আল্লাহ বলেছেন যে, সিয়ামের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন হবে। তাকওয়া অর্থ হলো হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে আত্মরক্ষার সার্বক্ষণিক অনুভূতি। যে কোনো কথা, কর্র্ম বা চিন্তার আগেই মনে হবে, এতে আল্লাহ খুশি না বেজার হবেন। যদি আল্লাহর অসন্তুষ্টির বিষয় হয় তবে কোনো অবস্থাতেই হৃদয় সে কাজ করতে দেবে না।
আমরা একথা স্বীকার করতে বাধ্য হব যে, পরিপূর্ণ তাকওয়া আমরা সিয়ামের মাধ্যমে অর্জন করতে পারছি না। একজন রোজাদার প্রচণ্ড ক্ষুধা বা পিপাসায় কাতর হয়েও কোনো অবস্থাতে পানাহার করতে রাজি হন না। নিজের ঘরের মধ্যে, একাকী, নির্জনে সকল মানুষের অজান্তে পিপাসা মেটানোর সুযোগ থাকলেও তিনি তা করেন না। কারণ তিনি জানেন তা করলে দুনিয়ার কেউ না জানলেও আল্লাহ জানবেন ও তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। এ হলো তাকওয়ার প্রকাশ। কিন্তু এ ব্যক্তিই রোজা অবস্থায় বা অন্য সময়ে এর চেয়ে অনেক কম পিপাসায় বা প্রলোভনে সুদ, ঘুষ, মিথ্যা, গিবত, ভেজাল, ওজনে ফাঁকি, কর্মে ফাঁকি, অন্যের পাওনা না দেওয়া ও অন্যান্য কঠিনতম পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছেন। কেন এরূপ হচ্ছে? এর অন্যতম কারণ হলো আমরা প্রেসক্রিপশন পাল্টে ফেলেছি। কোনো রোগে যদি ডাক্তার দুটি বা তিনটি ওষুধ দেন, আর রোগী একটি ওষুধ খেয়ে সুস্থ হতে চান তাহলে তিনি প্রকৃত সুস্থতা লাভ করতে পারবেন না। মহান আল্লাহ তাকওয়া অর্জনের জন্য আমাদের দুটি বিষয় একত্রে দিয়েছেন: সিয়াম ও কুরআন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা সিয়াম নিয়েছি এবং কুরআন বাদ দিয়েছি। এজন্য প্রকৃত ও পরিপূর্ণ তাকওয়া অর্জন করতে পারছি না।
আল্লাহ বলেছেন, “রামাদান মাস। এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমরাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে সিয়াম পালন করে।” (সূরা বাকারা: ১৮৫ আয়াত)
“তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে ও শিক্ষা দান করে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।” (সহীহ বুখারী ৪/১৯১৯)
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি বর্ণ পাঠ করবে সে একটি পুণ্য বা নেকি অর্জন করবে। পুণ্য বা নেকিকে দশগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে।” (তিরমিযী ৫/১৭৫, নং ২৯১০) অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াতে সুপারদর্শী সে সম্মানিত ফিরিশতাগণের সঙ্গে। আর কুরআন তিলাওয়াত করতে যার জিহ্বা জড়িয়ে যায়, উচ্চারণে কষ্ট হয়, কিন্তু কষ্ট করে অপারগতা সত্ত্বেও সে তিলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার।” (সহীহ বুখারী ৬/২৭৪৩, সহীহ মুসলিম ১/৫৪৯)
অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা কুরআন পাঠ করবে; কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার সঙ্গীদের (কুরআন পাঠকারীগণের) জন্য শাফা’আত করবে।”২ (সহীহ মুসলিম ১/৫৫৩)
এভাবে আমরা দেখছি যে, মহান আল্লাহ কুরআনের সঙ্গে রামাদানের সিয়ামকে জড়িত করেছেন। হাদিস থেকে জানা যায় যে, দুভাবে এ সংশ্লিষ্টতা। প্রথমত রামাদানে রাতদিন কুরআন তিলাওয়াত করা এবং দ্বিতীয়ত রাতে কিয়ামুল্লাইল বা তারাবিহের সালাতে কুরআন পড়া বা শুনা। মুমিনেরর অন্যতম ইবাদত কুরআন তিলাওয়াত করা। আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ট যিক্র কুরআন তিলাওয়াত। কুরআন কারিমের একটি আয়াত শিক্ষা করা ১০০ রাক’আত নফল সালাতের চেয়েও উত্তম বলে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে। সারা বৎসরই তিলাওয়াত করতে হবে। বিশেষত রামাদানে বেশি তিলাওয়াত করা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিশেষ সুন্নাত, যাতে অতিরিক্ত সাওয়াব ও বরকত রয়েছে।
“রোজা আমারই খাতিরে এবং আমি নিজে উহার পুরস্কার দিব।” রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন, “রোজা খাছ আল্লাহর জন্য রোজাদারের ছওয়াবের পরিমাণ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেহই বলিতে পারে না।” শা’বান মাসের শেষ তারিখে হযরত একটি ভাষণে বলিয়াছে, “হে লোক সকল! তোমাদের কাছে একটি মহা মাস একটি বরকতের মাস আগমন করিয়াছে; উহার মধ্যে এমন একটি রাত্রি আছে যাহা হাজার মাস হইতেও শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তা’আলা এই মাসের রোজা ফরজ করিয়াছেন। যে ব্যক্তি এই মাসে একটি নফল এবাদত করিবে; সে অন্য মাসের একটি ফরজ আমলের সমান ছওয়াব পাইবে। আর যে ব্যক্তি কোন একটি ফরজ এবাদত করিবে, সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ এবাদতের সমান ছওয়াব পাইবে। ইহা ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের পুরস্কার হলো জান্নাত। ইহা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির মাস।
ইহা এমন মাস, যাহাতে মুমিনের রিজিক বর্ধিত হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি এই মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, ইহা তাহার গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার এবং জাহান্নাম হতে মুক্তির কারণ হবে। আর এই ইফতারকারীও রোজাদার ব্যক্তির সমপরিমাণ ছওয়াব পাবে অথচ এইজন্য রোজাদারের ছওয়াব আদৌ কমবে না।
ইফতার করানো অর্থ আনুষ্ঠানিকতা নয়। দরিদ্র সাহাবী-তাবিয়ীগণ নিজের ইফতার প্রতিবেশীকে দিতেন এবং প্রতিবেশীর ইফতার নিজে নিতেন। এতে প্রত্যেকেই ইফতার করানোর সাওয়াব পেলেন। অনেকে নিজের সামান্য ইফতারে একজন মেহমান নিয়ে বসতেন। আমাদের সকলেরই চেষ্টা করা দরকার নিয়মিত নিজেদের খাওয়া থেকে সামান্য কমিয়ে অন্যদের ইফতার করানো। বিশেষত দরিদ্র, কর্মজীবী, রিকশাওয়ালা অনেকেই কষ্ট করে রোজা রাখেন এবং ইফতার করতেও কষ্ট হয়। সাধ্যমতো নিজেদের খাওয়া একটু কমিয়ে এদের খাওয়ানো দরকার। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তাহলে সে উক্ত রোজাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তবে এতে উক্ত রোজাদারের সাওয়াব একটুও কমবে না।” (তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৭১)
সাহাবাগণ বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আমাদের প্রত্যেকেরই ইফতার করাবার মতো স্বচ্ছলতা নাই। হযরত বললেন, যে ব্যক্তি একটি খেজুর, অথবা একটু পানি অথবা মিশ্রিত দুধের শরবত দ্বারাও রোজাদারকে ইফতার করাবে, আল্লাহ তা’আলা তাকে ঐ পরিমাণ ছওয়াব দিবেন। আর কোন ব্যক্তি যদি রোজাদারকে তৃপ্তির সঙ্গে ইফতার করায়, আল্লাহ তা’আলা তাকে হাউজে কাউছার হতে পানীয় দান করবেন। অতঃপর সে বেহেশতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আর তৃষ্ণাই হবে না। আর যে ব্যক্তি এই মাসে চাকরের কর্তব্য হাল্কা করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের অগ্নি হতে মুক্তি দান করবেন। এটা এমন মাস, যার প্রথম অংশে রহমত, মধ্যাংশে মাগফিরাত আর শেষাংশে নাজাত।
ড. মাহবুবা রহমান: সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা।
এসএন