রমজানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি
রমজানের আগামনীবার্তা শুনিয়ে বিদায় নিতে চলেছে শাবান মাস। রহমত, নাজাত আর মাগফিরাতের বার্তা নিয়ে আসা রমজানের অপেক্ষায় প্রহর গোনা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। রমজান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুমিনদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ। এ মাসে প্রতি আমলের প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা সত্তরগুণ বাড়িয়ে দেন।
শাবান মাসেই আল্লাহর রাসুল (সা.) রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। সাহাবায়ে কেরামদের (রা.) নিয়ে মজলিশ করতেন। রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি শাবান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি বেশি নফল রোজা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও নামাজ আদায় করে মাহে রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতেন।
রমজান যেহেতু মুসলিম উম্মাহর জন্য এক আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হয়, মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য রমজানের যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবন করা। সব মুমিনের উচিত রমজান আসার আগেই রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। নিজের জীবনকে আমলের মাধ্যমে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস, যে মাসে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শন এবং সুপথের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের প্রভেদকারী কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসে (নিজ আবাসে) উপস্থিত থাকে সে যেন সিয়াম পালন করে এবং যে ব্যক্তি পীড়িত অথবা প্রবাসী, তার জন্য অন্য কোনোদিন হতে গণনা করবে; তোমাদের পক্ষে যা সহজসাধ্য আল্লাহ তাই ইচ্ছা করেন ও তোমাদের পক্ষে যা দুঃসাধ্য তা ইচ্ছা করেন না এবং যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করে নিতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন তজ্জন্য তোমরা আল্লাহকে মহিমান্বিত কর এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)
রোজা পালনকারীদের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, সওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে।’ (বুখারি : ১৮৯৬)
এমন বরকতময় মাসকে কাজে লাগানোর জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। কোনোরকম হেলায় যেন পবিত্র এই মাসের ফজিলত হাতছাড়া না হয় সেই দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
আমলের প্রস্তুতি
রমজান মাস যেহেতু আমলের মাস, তাই এ মাসের মুখ্য বিষয় হওয়া দরকার আমল। কীভাবে আমলের পাল্লা ভারী হবে, পরকালে নাজাত পাওয়া যাবে, সেই লক্ষ্যে রমজানকে অতিবাহিত করাই হবে একজন মুমিনের আসল কাজ। রমজানের শুরুতেই একটা খসড়া তৈরি করা দরকার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমতো জামাতের সঙ্গে আদায় করার পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াত করবেন, জিকির আজকার করবেন–তার একটা টার্গেট নির্ধারণ করা দরকার। বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেতে পারে। যারা কোরআন তেলাওয়াত জানেন না অথবা শুদ্ধ করে তেলাওয়াত করতে পারেন না, তারা এই রমজানে কোরআন শেখার কাজটা শেষ করতে পারেন। প্রতিদিন তারাবিগুলো ঠিকমতো আদায় করা। নফল নামাজ পড়ার জন্য দৈনন্দিন একটা টার্গেট ঠিক করা যেতে পারে।
পারিবারিক প্রস্তুতি
রমজানকে সামনে রেখে পারিবারিক প্রস্তুতিও গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক কেনাকাটা, বাজার সদাই, আত্মীয় বাড়ি যাওয়া রমজানের পূর্বের সেরে ফেলা দরকার। এতে রমজানে উটকো ঝামেলা থেকে নিজেকে রক্ষা করে নিমগ্ন হয়ে ইবাদত করা যায়। সেই সঙ্গে ঘরের সদস্যদের নিয়ে প্রতিদিন রমজানের ফাজায়েল-মাসায়েল আলোচনা করতে পারেন। এতে করে সবার মধ্যে রমজানের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন। পরিবারের প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্য যেন রোজা পালন করে সেই বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। সেইসঙ্গে রোজা থাকা অবস্থায় ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলতে হবে। অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কাজ করবে না। যদি কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুবার বলে, আমি সওম পালন করছি। ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই সওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে। সিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশগুণ।’ (বুখারি : হাদিস ১৮৯৪)
সামাজিক প্রস্তুতি
সমাজের সবাইকে নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো যেতে পারে। গরিব-অসহায় ব্যক্তিদের সম্মিলিত বা এককভাবে সহায়তা করতে হবে। তাদের রমজানটাও যেন দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত হয় সেই ব্যবস্থা করা দরকার।
অফিস প্রস্তুতি
যারা অফিস-আদালতে কাজ করেন, সম্ভব হলে কিছু কাজ অগ্রিম করে রাখতে হবে। অথবা প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন করে রাখতে হবে। এর ফলে কাজের বাড়তি চাপ কম থাকার ফলে আপনার সারাদিন টেনশন মুক্ত থাকবে। সেই সঙ্গে সম্ভব হলে অফিসের ফাঁকে ফাঁকে নামাজ, তেলাওয়াতসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমলের পরিবেশ করে রাখতে পারেন।
ব্যবসায়িক প্রস্তুতি
যারা ব্যবসা করেন, তারা রাসুলের (সা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত পালন করছেন। তবে ব্যবসা অবশ্যই রাসুলের দেখানো পথে হতে হবে। রমজান মাসে অন্তত দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে হবে। সিন্ডিকেট করে মূল্য বৃদ্ধি থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের প্রতি যে সুসংবাদ, ‘সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীকীন, শহীদগণ ও নেককারদের সঙ্গে থাকবেন।’ এ লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়াও মেহমানদারি, অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ, দান-সদকা, গুনাহের মাধ্যমগুলো এড়িয়ে চলার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে।
এসএ/