রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্ল্যানচেটের চল ছিল। রানী মহলানবীশকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির সূত্র ধরে অমিতাভ চৌধুরী কবির পরলোকচর্চা বিষয়ে আগ্রহী হন। কৌতূহলের বশেই তিনি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে খুঁজে পেয়েছিলেন আটখানি খাতা। প্রশ্ন-উত্তর মিলিয়ে সেই অলৌকিক সংলাপ যথাসাধ্য আমাদের সবার জন্য তুলে দিয়েছেন লেখক।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বলছেন – “ বহু দুঃখ, বহু শোক তাঁর ভিতরে জমা ছিল। অশরীরী প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বার্তায় কখনও বেরিয়ে পড়েছে স্নেহশীল পিতার রূপ, কখনও বা স্ত্রী বিয়োগ বিরহী স্বামীর ছবি। আবার দেখি কখনও তিনি প্রিয়শিষ্যবিচ্ছেদে শোকাছন্ন কবি, কখনও বা পরলোকগত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের কাছে রয়ে গেছেন সেই ‘ছোট রবি’।আত্মার অস্তিত্ব ও প্ল্যানচেট নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন চিঠিপত্রের অংশ এই বইতে পাওয়া যায়। প্রাথমিক ভাবে মিডি য়াম নিয়ে কবির সন্দেহ থাকলেও আত্মাদের উত্তরের প্রকৃতি দেখে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস জন্মায় এ বিষয়ে।
আর কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে বলতেন- ‘নূতনকে জানার আগ্রহ কেন হবে না, জানতে দোষ কী!’প্ল্যানচেটে মিডিয়াম হতেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের কন্যা উমা- ডাকনাম বুলা। আহ্বায়ক- রবীন্দ্রনাথ। লিপিকর: অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী ও মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়।প্ল্যানচেটের সঙ্গী হতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, মীরা দেবী প্রমুখরা। প্ল্যানচেটে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা, কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ, ছোট বউ মৃণালিনী, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ, হিতেন্দ্রনাথ, ভ্রাতুষ্পুত্রী অভিজ্ঞা, অজিত চক্রবর্তী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়- এছাড়াও আরো অনেকে।
প্ল্যানচেটের সময় অনেক অযাচিত আগন্তুকরাও আসতেন। তাঁদের কেউ নাম বলেছেন, কেউ বলেননি। কেউ বলেছেন ‘তাঁদের কাজ অন্য আত্মাকে পৌঁছে দেওয়া’। নতুন বৌঠান ছাড়া রবীন্দ্রনাথ বারবার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান শমীন্দ্রনাথকে নিয়ে।
নিকট আত্মীয় বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথ বিদেহী আত্মাদের প্রশ্ন করেছেন মূলত তিনটি- “ *(এক) আপনার বা তোমার ধর্মবিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি-না *(দুই) পরলোকে স্ত্রী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক কী রকম এবং উভয়ের মধ্যে সম্ভোগবাসনা আছে কি-না এবং *(তিন) নূতন জন্ম নিতে ইচ্ছে হয় কিনা। ’’
এই প্রশ্নগুলির সম্ভাব্য কারণ অমিতাভ চৌধুরী সন্ধান করেছেন। পুনর্জন্ম নিতে চান কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ বলেছিলেন রাজি, কেউ বলেছিলেন চান না। সুকুমার রায় প্ল্যানচেটে রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন ছেলে সত্যজিৎ-কে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করে নিতে। সত্যজিৎ আশ্রমে এসেছিলেন বড় হয়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজের অভিনয়, কবিতা নিয়েও জানতে চেয়েছেন প্ল্যানচেটে। কবির ছবি যে ইউরোপে বিশেষ স্বীকৃতি পাবে আগাম জানিয়েছিলেন প্ল্যানচেটে আগতরাই! আবার আত্মার অনুরোধে গান শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। অমিতাভ চৌধুরী একটি বিশেষ দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বই-এর শেষভাগে।
মিডিয়াম উমা দেবী ১৯৩১ সালে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে নিজেই চলে গিয়েছিলেন পরলোকে। যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘পারলৌকিক যোগাযোগের সেতু’। বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ জগদীশ ভট্টাচার্য তাঁর ‘কবিমানসী’র- প্রথম খন্ডে রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট নিয়ে পরীক্ষা এবং মিডিয়াম হিসেবে উমা দেবীকে নিয়ে তথ্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন।
আলোচ্য বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তটি আমাদের যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে – “মিডিয়ামের সাহায্যে অতিপ্রাকৃত সত্যানুসন্ধান সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের বক্তব্য হল, চিঠিপত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, কবি নিজে ওতে বিশ্বাস করতেন এবং মিডিয়ামের সাহায্যে নতুন-বৌঠানের সঙ্গে বলার জন্যে তিনি আগ্রহান্বিত ছিলেন। … মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা চিঠিতে কবি যে “আকাঙ্ক্ষার প্রমাণের’’ কথা বলেছেন সেদিক থেকে চিন্তা করলেও বলা যায় যে, “কৈশোরিকা’’র সঙ্গে পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষাই অতিপ্রাকৃত অস্তিত্বে বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকে সুদৃঢ় করে রেখেছে। “ মর্ত্যবন্ধনমুক্ত যোগ’’ নিত্য করে রেখেছে উভয়ের সখ্যকে।’’
একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে মানুষ রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে পরলোকচর্চার দিকেও নজর দিতে হবে। কেউ কেউ আবার এই প্রবণতাকে বলতে চেয়েছেন ‘মহাপৌরুষেয় ছেলেমানুষী।’ অবশ্য জানার মাঝে অজানার সন্ধানে যে সংলাপ রচিত হয়েছিল, সেগুলি বই থেকে পড়ে আমাদের শিহরণ জাগে বৈকি।
ডিএসএস/