শিক্ষাব্যবস্থা: উল্টোপথে উল্টোরথে!
বহুদিন ধরে আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থা বহুধাবিভক্ত, বির্তকিত, প্রশ্নবিদ্ধ। সামগ্রিক অর্থেই ঝুলে আছে টেকসই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। কোনো পরিকল্পনায় যেন এখানে যথেষ্ট নয়। সারাবিশ্ব শিক্ষা নিয়ে যে দিকে চলে আমরা আছি বিপরীত মেরুতে। বলতে গেলে এ যাত্রা আমাদের উল্টোপথে উল্টোরথে অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে। নানামুখী বিতর্ক প্রমাণ করে সঠিক ট্রাকে নেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বিতর্ক শুধু যে প্রতিপক্ষের ভেতর থেকে আসছে তা নয় সংবিধানের মতো ৭০ অনুচ্ছেদের ঝামেলা নেই বলে শাসক শ্রেণির মধ্যে, ক্ষমতাসীনদের মধ্য থেকেও মাঝেমধ্যে এ বিষয়ে হুঙ্কার শোনা যায়।
উন্নত দেশগুলো শিক্ষায় যেভাবে উন্নতি করে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের সুফল পায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিগত ৫২ বছরে শাসন সংগঠনগুলোর সিদ্ধান্ত কখনই সেই অনুকূলে ছিল না। আমাদের দেশের মাটি পৃথিবীর অন্যান্য যেকোনো দেশের থেকে উর্বর। আর একারণেই বিভিন্ন সময়ে বিদেশি শক্তিগুলো এদেশের মাটি দখল করে ঘাঁটি গেড়ে বসার অপচেষ্টা করেছিল। সর্বশেষ ইয়াহিয়া খানও বলেছিল, এদেশের মানুষ চাই না, এদেশের মাটি চাই। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই সেই মাটি পেয়েও আমরা কাঙ্ক্ষিত সোনা ফলাতে পারিনি।
অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, নীতি নির্ধারণের ধরন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রমাণ করে এ কাজে জড়িতদের মস্তিষ্ক কত ঊষর। আশির দশকে কৃষকের বন্ধু শাইখ সিরাজ তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছিলেন জাপানের মাটি আমাদের দেশের মাটি থেকে ১৭ গুণ বেশি অনুর্বর। আমাদের এই সম্ভাবনাময় জন্মভূমিতে একটা বীজ ফেললেই আমরা ফল আশা করতে পারি, জাপানে যেটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক এতটাই অনুর্বর যে আমরা আজকে যেটা ভাবি জাপান সেটা ২৫ বছর আগেই ভেবে রেখেছে। অথবা আজকে জাপান যেটা ভাবছে আমরা ২৫ বছর পরে সেটা হয়ত ভাবার অবকাশ পাব। কারণ ওই একটাই ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থা, তথাকথিতদের মস্তিষ্ক বিকৃতি। ফলে মেধাপাচার। আর চমক হাসানরা আমাদের দেশে টিকতে না পারলেও মার্কিন মুলুকে ঠিকই চমক দেখায়। সর্বগ্রাসী সিদ্ধান্তহীনতায় শিক্ষাব্যবস্থা এখন মগবাজার ফ্লাইওভারের মতো। তৈরির পরে মনে হয় ভুল হয়েছে। ভাঙতে হবে।
সরকার জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে কোনো টেকসই পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই। সেটা সফল হয়নি। সৃজনশীলতার ব্যর্থতার উপর ভর করে আবার নতুন করে শিক্ষা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা শুরু করেছে সরকার। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতার নামে চলেছে নজিরবিহীন নৈরাজ্য। কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই শুরু করা হয় এই কর্মযজ্ঞ। এর ব্যর্থতার ভিতের উপর ভর করে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হতে চলেছে নতুন পদ্ধতি; যেখানে বিজ্ঞানকে কুক্ষিগত, কোণঠাসা করে শিক্ষা গ্রহণের বয়সসীমাকে আটকে দেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী একযোগে শুরু এই চটকদার কথায় কাজের কাজ কিছুই হয়নি, হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা লুটপাট।
নতুন করে প্রত্যাহার করে নেওয়া বই ছাপতে আরও লাগবে ৩৫ কোটি টাকা যা রীতিমতো অপচয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সম্ভবত বাংলাদেশই হবে পৃথিবীতে এমন দেশ যারা শিক্ষাব্যবস্থায় এমন হঠকারী সিদ্ধান্তের নীল নকশার মূল রূপকার। আমরা মুখে বলি শিক্ষার কোনো বয়স নেই। সারা বিশ্বে সেটাই প্রচলিত, তামাম দুনিয়া সেটাই বিশ্বাস করে অথচ ২০২৩ সালের নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের বাস্তবতা সমগ্র বিশ্বের উল্টোপথে। বিশ্বের কোথাও এই ব্যবস্থা না থাকলেও বাংলাদেশে সৃষ্টি করল অনন্য নজির।
প্রাথমিক এই প্রবণতা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। বলা হয়েছিল বয়স ৬ লাগবে প্রাথমিকে ভর্তি হতে, এবার বলা হচ্ছে কোনো শিক্ষার্থীর বয়স ১২ বছর পূর্ণ না হলে এবং ১৮ বছরের বেশি হলে সে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে না। আর এমন বয়সের সীমানা প্রাচীর দিয়ে নবম শ্রেণিতে ছাত্র-ছাত্রী নিবন্ধনের নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড।
আর এভাবেই উল্টোপথে উল্টোরথে আমাদের শিক্ষার বারোটা বেজে যাচ্ছে। আজকের এই শুরুর ফল আমরা পাব আরও কিছুদিন পরে যখন হয়ত আমরা নতুন কোনো শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ভাবব যে সংস্কৃতির ঐতিহ্য আমরা লালন করছি বহুদিন ধরে। পতনের এখানেই শেষ নয়। মানুষের মৌলিক চাহিদার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শিক্ষা; যার অবস্থান চতুর্থ নম্বরে। বলা হচ্ছে, মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা শিক্ষা পূরণ হলে অন্য চাহিদাগুলো আপনা-আপনিই পূরণ হয়ে যায় অথচ আমরা বলে দিচ্ছি কোনো শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছরের বেশি হলে সে আর নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে না। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করা ফরজ কাজটাও জীবনব্যাপী চলমান একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের দেশে যা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার নামে প্রিয় পাঠক জানাবেন কোনো সভ্য দেশে কি এমন হতে পারে?
অত্যন্ত নিলর্জ্জভাবে বলা হচ্ছে, ২০২৩ সাল থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো বিভাগ থাকবে না অর্থাৎ আলাদা করে বিজ্ঞান বিভাগ বলে কোনো বিভাগ থাকছে না। তাহলে ডাক্তার, প্রকৌশলী আমরা কোথাই পাব? তাহলে শিক্ষা নিয়ে কি আমরা আবারও নতুন কোনো অব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে চলছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের মতে ‘আমরা শুধু প্রশাসক তৈরির দিকে যাচ্ছি না তো’ বাস্তবে আসলে হচ্ছে সেটাই। গণিত কারা শিখবে অথবা বিশেষ মেধার এই মানুষ তৈরির পাইপলাইন ভেঙে দিচ্ছি কেন আমরা। অথচ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে উচ্চতর গণিত ঠিকই থাকছে। তেল-ঘি একদরে বিক্রির মগের মুল্লুক কি তাহলে হতে চলেছে আমাদের এই স্বপ্নের বাংলাদেশ?
এখানেও আমরা আছি উল্টোদিকে উল্টোপথে। সিলেবাস থেকে বিজ্ঞান শিক্ষাকে অবহেলা করে আমরা কীসের অশনি সংকেত দিচ্ছি। কেননা বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব এই বিশ্বায়নের যুগে বলে শেষ করা যাবে না চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে। উন্নত দেশগুলোতে আমরা এখনো দেখি বিজ্ঞানের গুরুত্ব এর নমুনা। সেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায় বিজ্ঞান অথচ আমরা!
ইসরাইল, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান- এশিয়ার এসব দেশ আজ বহুদূর এগিয়েছে শুধু বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ ও বিনিয়োগের কল্যাণে। জমিতে ৫০ মণ ধান উৎপাদনের চেয়ে আমরা কেন একটা স্যামসাং উৎপাদন শেখানোর চেষ্টা করছি না, রাষ্ট্র চাচ্ছে না, শুভংকরের ফাঁকির মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাত নিয়ে চালাকি নতুন কিছু নয়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। সৃজনশীলতার মতো কয়েক বছর পরে সবকিছু ভেঙেচুরে নতুন করে করার মানে হলো কথিত আমলাদের দ্বারা সেকেন্ড হোম কিংবা বেগমপাড়াসমৃদ্ধ হওয়ায় নতুন প্রকল্পের নীলনকশা। বিশ্বের সবদেশেই কম-বেশি সমস্যা রয়েছে। তারপরও শিক্ষায় সমস্যা নিয়ে টিকে থাকা রাষ্ট্রের সংখ্যা নেহায়েত বেশি নয়। অনেক নবীন রাষ্ট্রও শিক্ষায় বহুমাত্রিক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে অথচ আমরা আছি উল্টোপথে উল্টোপথে।
আমাদের স্বাধীনতার বয়স পেরিয়েছে ৫০ তবুও শিক্ষায় রয়েছে পাহাড়সম সমস্যা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স-মাস্টার্স সমস্যা যা ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকারের টনক নড়েনি। আছে এবতেদায়ী সমস্যা, সরকারি-বেসরকারি মর্যাদাঘটিত সমস্যা, স্কুল-মাদ্রাসার সমস্যা, শিক্ষকদের বেতন কাঠমো, সনদ জালিয়াতি, জাল শিক্ষক ইত্যাদি সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার কোনো কালেই আন্তরিক ছিল না, এখনো নেই আগামীতেও থাকবে বলে মনে হয় না।
প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষায় এত সমস্যা বিরাজমান তথাপিও নতুন একটি সমস্যা সবাইকে ভাবিয়ে তুলতে পারে বলে মনে হচ্ছে। আর সেটা হলো শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক শিক্ষার্থীদের মূল্যয়ন প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়া তখনই সফল হতে পারে যখন সেটা রাজনীতির বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যাচাই করার সুযোগ থাকবে। যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধারাবাহিক মূল্যায়ন করবে, পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম থাকছে শিক্ষকদের হাতে, থাকছে নম্বর। আর এখানেই দেখা দেবে যত বিপত্তি, শিক্ষকরা ফেরেস্তা নয়। তারা ক্ষমতাসীন দলের আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ চাকরি বাগিয়েছেন, কাজেই শিক্ষকের হাতের নম্বর যে ক্ষমতাসীনদের উত্তরাধিকারদের দখলে থাকবে সেকথা জোর দিয়েই বলা যায়।
বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যেভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে তাতে রাজনৈতিক বিবেচনায় সঠিক মূল্যায়ন যে বেঠিকভাবে হবে একথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, তৈলমর্দন, মোসাহেবী, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের নামে যেভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরুদণ্ডহীন করার পায়তারা করা হয়েছে তাতে এমন শঙ্কা রয়েই গেছে।
শুধু তাই নয় আমলাতান্ত্রিক সংক্রীর্ণতা, উপনিবেশিক মানসিকতা, একচোখা পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ না করে সর্বজনীন শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়নের দাবি সময়ের প্রয়োজনে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মিলে এক যুগ আগে কিছু যুগান্তকারী প্রস্তাব করেছিলেন; যেগুলো বাস্তবায়নে আন্তরিক হোন আর যদি রাষ্ট্র সেটা করতে না পারে তাহলে অনিবার্য পতন রোধের বিকল্প রক্ষাকবজের প্রস্তুতি নিন। তা না হলে রাষ্ট্রের পতন আসমান জমিনে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে দেশে শুধু শিক্ষা থাকবে কিন্তু যে মানুষের জন্য শিক্ষা সে মানুষ আর থাকবে না।
হাসিবুল হাসান: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষা গবেষক
এসএন