অ্যামট্রেক অ্যাসেলার জানালায়!
অনেকদিন হলো অ্যামট্রেকে চড়া হয় না। চড়ব চড়ব করেও যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়নি অনেকদিন। কিন্তু কোথাও যেতে চাই অ্যামট্রেকে চড়ে। তা ছাড়া ম্যানহাটনে অ্যামট্রেকের নতুন স্টেশন ’ময়নিহান ট্রেন হল’ উন্মুক্ত করা হয়েছে। সেটিও দেখার খুব শখ। কিন্তু কোনোভাবেই যেন হয়ে উঠছিল না। প্রায় ছয় মাস দেশে থেকে মাত্র অল্প কিছুদিন হলো যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছি। দেশ থেকে ফিরে এবার বেশির ভাগ সময়ই নিউইয়র্কে অবস্থান করছি লেখক সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরন ভাইয়ের সঙ্গে তার বাসায়। কিরন ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় সম্পর্ক। একজন আরেকজনকে দাদু বলে সম্বোধন করি। তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন, বন্ধুর মতো করে চলাফেরা করেন, ভালোবাসেন।
আকবর হায়দার কিরন দীর্ঘদিন ধরেই ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং পরে তিনি ভয়েস অব আমেরিকার নিউইয়র্ক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন বহুদিন। ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর তিনি নিউইয়র্ক বাংলা ডট কমের সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। নিউইয়র্কের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সবার প্রিয় আকবর হায়দার কিরন। একাকী নিভৃত জীবন যাপন আকবর হায়দার কিরন ভাইয়ের। নিজের মতো করেই থাকেন নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই তিনি থাকেন। আপনজনের সঙ্গেই তার মেলামেশা। তার আপনজনের মধ্যে রয়েছে নীহার সিদ্দিকী, আবিদ রহমান, মিনহাজ আহমেদ ও সদ্য প্রয়াত সিনিয়র সাংবাদিক মাঈন উদ্দীন আহেমদসহ নিউইয়র্কের সব সিনিয়র আর বাঘাবাঘা সাংবাদিক সমাজসেবীরা। আর আমাদের জ্যাকসন হাইটসে আড্ডার জায়গা বিখ্যাত সাকিল মিয়া’র গ্রাফিক্স ডিজাইন।
আড্ডা দিচ্ছিলাম সাকিলের গ্রাফিক্স ডিজাইনে। হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠল। ওয়াশিংটনে যাওয়ার ডাক। দীর্ঘদিনের সহকর্মী সাদেক খান, জুয়েল বড়ুয়া ও জিআই রাসেল সবাই মিলে ওয়াশিংটন যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। ভাবলাম এই সুযোগ। অ্যামট্রেকে চড়েই ওয়াশিংটন যাব। এতে যেমন ট্রেনে ভ্রমণ করা হবে তেমনি নতুন ময়নিহান স্টেশন ট্রেন হলও দেখা হবে। ওদের বললাম আসব অ্যামট্রেকে চড়ে। টিকিট কেনার পর কবে কখন কোথায় জানিয়ে দেব। টিকিট খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু দরদামে যেন বনছিল না। টিকিটের আকাশ ছোঁয়া মূল্য।
অনলাইনে প্রতিদিনই খুঁজি টিকিট। ৮ জুন প্রায় দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টা। কিরন ভাইয়ের বাসায় আমার আপাতত স্থায়ী ঠিকানা। ওখানে আমার ল্যাপটপেই অ্যামট্রেকের টিকিট খুঁজছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ করেই টিকিট পেয়ে গেলাম। কেটে ফেললাম সঙ্গে সঙ্গেই। ই-টিকিট ই-মেইলে আসতেই দেখি আজই দুইটায় ট্রেন ছেড়ে যাবে ময়নিহান হল থেকে। হাতে বেশি সময় নেই। কুইন্সের উডসাইড থেকে ম্যানহাটন যেতে হবে। পথে ট্রাফিক হবে। দেরি না করে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম। কিরন ভাই পাশেই ছিলেন। আমাকে ব্যাগ গুছাতে দেখে বললেন,
’কি হলো! কোথায় যাচ্ছেন।’
ওয়াশিংটন ডিসি যাব। দুইটা বাজে ট্রেন। হাতে সময় নেই।’
কিরন ভাই কিছুটা অবাক হলেন। বললেন, জ্যাকসন হাইটস থেকে ই-ট্রেনে পেন স্টেশনে চলে যান। তা নাহলে রাস্তায় ট্রাফিক হবে। ট্রেন মিস করতে পারেন।
ট্রেনে ব্যাগ নিয়ে ঝামেলা হবে। এক ট্রেন থেকে আরেক ট্রেনে ব্যাগ বাক্স নিয়ে টানাটানি করে ঝামেলায় পড়ে যাব।
তাহলে উবারেই চলে যান। কয়দিন থাকবেন ওয়াশিংটন।
দেখি কতদিন থাকা যায়। ফেরার টিকিট কনফার্ম করে আপানকে জানাব।
ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে যান। সময় বেশি নেই।
ব্যাগ গুছিয়ে উবার কল করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসার সামনে চলে এল উবার। কিরন ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উবারে উঠে বসলাম। উবারে বসে ঘড়ির দিকে তাকাতেই টেনশন বেড়ে গেল। প্রায় সোয়া একটা। ট্রেন ২টায়। ট্রাফিক জ্যামে পড়ে ট্রেন না আবার মিস হয়ে যায়। কুইন্স বুলুভার্ড দিয়ে হাইওয়ে ২৭৮ ব্রুকলিন কুইন্স এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে মিডটাউন টানেলের উদ্দেশে ছুটে চলেছে উবার। ইস্ট রিভার পাড়ি দিয়ে ম্যানহাটনে ঢুকতইে প্রচণ্ড জ্যামে পড়ে গেলাম। টেনশন আরও বেড়ে গেল। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১টা ৪০ মিনিট। ২০ মিনিট সময় আছে। দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করলাম। ১টা ৫০ মিনিটে এসে ড্রাইভার আমাকে পুরাতন পেন স্টেশন সেভেন্থ এভিনিউ ৩২ স্ট্রিটের গেটে নামিয়ে দিল। দ্রুত নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে টেনশনে ভুলেই গেছি পেন স্টেশনে নয়, যেতে হবে অ্যামট্রেকের নতুন ময়নিহান ট্রেন হলে। ওটা এইটথ্ ও নাইনথ্ এভিনিউর মাঝে। পুরাতন পেন স্টেশনের সামনে দাঁড়ানো এক আফ্রিকানকে জিজ্ঞাসা করতেই সেও জানিয়ে দিল পরের ব্লকে অ্যামট্রেকের নতুন স্টেশন ময়নিহান ট্রেন হল।
ব্যাগ নিয়ে মাটির নিচ দিয়ে পুরাতন পেন স্টেশনের ভেতর দিয়েই ছুটতে শুরু করলাম। বের হয়ে এলাম এইটথ্ এভিনিউ ৩১ স্ট্রিটের কর্নারে। বের হতেই চোখে পড়ল রাস্তার অন্যপাশে অ্যামট্রেকের নতুন ময়নিহান ট্রেন হলের সাইন। রাস্তা পার হয়ে দ্রুত ঢুকে পড়লাম স্টেশনের ভেতরে। ভাগ্য ভালো স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করতেই স্টেশনের একজন কর্মকর্তার দেখা মিলল। মোবাইল ফোনে ই-টিকিট দেখাতেই সে আমাকে ১৫/১৬ নম্বর ট্র্যাকের চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে বলল। ট্রেন ওখানেই ১৬ নম্বর ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে আছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কয়েক মিনিট সময় আছে। স্বস্তি ফিরে এল মনে-প্রাণে। চোখ মেলে চারিদিকে তাকালাম। চারিদিকে ডিজিটাল বোর্ডের ছড়াছড়ি এবং প্রতিটি ডিজিটাল স্ক্রিনেই ট্রেনের যাবতীয় তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। যাত্রীরাও দেখে নিচ্ছে তাদের ট্রেনের বিভিন্ন তথ্য।
ড্যানিয়েল প্যাট্রিক "প্যাট" ময়নিহান। জন্ম মার্চ ১৬, ১৯২৭ এবং ২০০৩ সালের ২৬ শে মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও কূটনীতিক। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট দলের একজন সদস্য। তিনি নিউ ইয়র্ক ডেমোক্র্যাট সদস্য হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং পরামর্শদাতা হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করেন।
ময়নিহানের জন্ম তুলসা ওকলাহোমা। অল্প বয়সে তিনি চলে আসেন নিউ ইয়র্ক সিটি। ইতিহাসের উপর তিনি টুফটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি নিউইয়র্ক গভর্নর ডাব্লু আভেরেল হ্যারিম্যানের স্টাফ হিসেবে কাজ করেন এবং পরে তিনি রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির প্রশাসনে সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন প্রশাসনে কাজ করেন এবং ১৯৬৫ সালে বিতর্কিত ময়নিহান রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এর পরপরই ময়নিহান জনসন প্রশাসন ছেড়ে দেন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯৬৯ সালে তিনি নিক্সন প্রশাসনে রাষ্ট্রপতির সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তিনি প্রশাসন ছেড়ে ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড তাকে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্টদূত হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন এবং জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনকালেই ১৯৭৬ সালে ডেমোক্র্যাট দলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ময়নিহান ১৯৭৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সিনেটে নিউইয়র্কের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। আমেরিকান রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও কূটনীতিক ড্যানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহানের নামেই নামকরণ করা হয়েছে পেন স্টেশনের নতুন হল ’ময়নিহান ট্রেন হল’।
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম গোলার্ধের ব্যস্ততম ট্রানজিট ম্যানহাটনের পেন স্টেশন। নিউইয়র্ক ও উত্তর-পূর্বের পরিবহন নেটওয়ার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত এই পেন স্টেশন। আর এই পেন স্টেশনের নতুন সংস্করণ ময়নিহান ট্রেন হল প্রকল্প যার মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছে ট্রেন যাত্রীদের অনেক সমস্যা। নিউইয়র্কে প্রতিদিন আগত যাত্রীদের স্বাগত জানাতে, ময়নিহান ট্রেন হল একটি দুর্দান্ত কেন্দ্রস্থল, যা পেন স্টেশনকে হাডসন ইয়ার্ডস, ম্যানহাটনের সুদূর পশ্চিম দিকে এবং তার বাইরে সংযুক্ত করেছে।
ময়নিহান ট্রেন হল শহরের নতুন গ্র্যান্ড সিভিক আইকন। ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি ১০০+ বছরের পুরোনো জেমস এ. ফারলে পোস্ট অফিস বিল্ডিংকে একটি আধুনিক, বিশ্ব-মানের ট্রানজিট হাব-এ রূপান্তরিত করে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত সিনেটর ড্যানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহান কোয়াটার সেঞ্চুরি পূর্বে এর প্রস্তাব করেছিলেন।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। যাত্রীরা তাদের নির্দিষ্ট ট্রেনের জন অপেক্ষমান রয়েছে। দ্রুত কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। তারপর নির্দিষ্ট সিঁড়ি বেয়ে মাটির অনেক গভীরে ট্র্যাক ১৬ এ দাঁড়ানো অ্যামট্রেক অ্যাসেলা ২১২১ ট্রেনে উঠে বসলাম। নির্দিষ্ট বগির নির্দিষ্ট সিট খুঁজে পেতেই দেখলাম জানালার পাশে সিট। বেশ ভালো লাগল। প্রকৃতি আর আকাশ দেখতে দেখতে ওয়াশিংটন চলে যাব।
নির্দিষ্ট সময়ে অ্যাসেলা ট্রেন ২১২১ ছেড়ে দিল। মাটির নিচ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে হাডসন নদীর নিচে ট্যানেলের ভেতরে প্রবেশ করল। হালকা একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল শরীরের একোন ওকোন দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে এল নিউ জার্সিতে। ধীরে ধীরে থেমে পড়ল ট্রেন। ট্রেন লাইনে সিগন্যাল কাজ করছে না বলে ঘোষণা এল ট্রেন কন্ডাক্টরের কাছ থেকে। তবে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। সিগন্যাল কাজ শুরু করতেই আবারও ছুটতে শুরু করল ট্রেন। নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসি প্রায় ২০৫ মাইল। এই ২০৫ মাইল পাড়ি দিতে অ্যামট্রেক অ্যাসিলা ট্রেনের সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। তবে যান্ত্রিক বা টেকনিক্যাল কারণে যদি দেরি হয় তাহলে এই সময় বেড়ে যেতে পারে।
ট্রেনের মাইকে ঘোষণা এল টিকিট চেকার আসবে। সবাই যাতে নিজ নিজ টিকিট ও আইডি প্রস্তুত রাখে। ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকিট চেকার একে একে সব যাত্রীর টিকিট ডিজিটাল ডিভাইসে স্ক্যান করে এক কম্পার্টমেন্ট থেকে আরেক কম্পার্টমেন্টে চলে গেল। অ্যামট্রেক অ্যাসেলাতে মোট ছয়টি কার বা বগি বা কম্পার্টমেন্ট থাকে। এ ছাড়া আছে দুই দিকে দুইটা ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের পর প্রথম কারটি প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য এবং দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম ও ষষ্ঠ কারটি বিজনেস ক্লাস যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত। চার নম্বর কারটি অ্যাসেলা ক্যাফে। এখানে যাত্রীদের জন্য নানা রকমের চা-কফি ও পানীয়সহ খাবার বিক্রি করা হয়। খাবার কিনে ক্যাফেতে বসেই খাওয়া যায় অথবা খাবার কিনে নিজের সিটে নিয়ে আসা যায়। প্রতিটি বগিতেই রয়েছে বাথরুমসহ লাগেজ রাখার ব্যবস্থা। অ্যামট্রেক অ্যাসেলার নিজস্ব ওয়াইফাই রয়েছে। ট্রেনে বসেই অফিস বা অন্যান্য কাজ নিজের ল্যাপটপে করা যায়।
চলতে চলতে ট্রেন নিউজার্সির নিউওয়ার্ক পেন স্টেশনে এসে থেমে পড়ল। যেসব যাত্রী নিউওয়ার্কের পেন স্টেশনে নামার তারা সবাই নেমে গেল। নতুন যাত্রী নিয়ে আবারও ট্রেন ছুটে চলল ফিলাডেলফিয়া পেনসালভেনিয়ার উদ্দেশে। নিজের সিটে বসে জানালা দিয়ে প্রকৃতির রূপ আর আকাশ দেখতে লাগলাম মুগ্ধ হয়ে। একের পর এক দৃশ্য পেছনে আর লোকাল ট্রেন স্টেশন ফেলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে অ্যামট্রেক অ্যাসেলা ২১২১। মাঝে মধ্যেই অন্যদিক থেকে আসা এনজে ট্রেন, নর্থ রিজিওনাল ট্রেন ছুটে যাচ্ছে নিউ ইয়র্কের দিকে।
এ ছাড়া লোকাল স্টেশনগুলোও যেন এসেই হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি সীমার বাইরে। কিছুক্ষণ পরপরই রেলওয়ের মেরামতের কারখানা চোখে পড়ল। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর ট্রেন ধীরে ধীরে এসে থেমে গেল ফিলাডেলফিয়া স্টেশনে। যাত্রীদের উঠনামা শেষ হতেই আবারও যাত্রা শুর হল পরবর্তী স্টেশনের উদ্দেশে।
দ্রুতগতির বিদ্যুৎচালিত ট্রেন অ্যামট্রেক অ্যাসেলা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রোদেলা আকাশের নিচ দিয়েই ছুটে চলেছে। চারিদিকে বাড়ি শহর শপিং সেন্টার নদী প্রকৃতি ছেড়ে ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। অ্যামট্রেক অ্যাসেলা ২১২১ এর পরবর্তী স্টেশন ডেলোওয়ার স্টেটের উইলমিংটন। আমার পাশের সিটে আছেন মধ্যবয়সী একজন মহিলা যাত্রী। শুরু থেকেই ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। সিনেমা দেখছেন আর নিজের মতো করেই আনন্দে মেতে আছেন। চারিদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে ও নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। নিজের সিনেমা দেখা নিয়েই ব্যস্ত। সিনেমা দেখতেই বারবার হেসে উঠেছেন আপনমনে। ভাবলাম এবার ক্যাফে যাওয়া দরকার। কিন্তু মহিলা যাত্রীর সিনেমা দেখার বা তার আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাতেও ইচ্ছে হলো না। আবারও প্রকৃতির দিকে নজর দিলাম।
অ্যামট্রেক ভ্রমণে কোনো বাড়তি খরচ নেই। এ ছাড়া এই ট্রেন আপনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে যায় কোনো ঝামেলা ছাড়াই। রাস্তায় বাস ও ট্র্যাফিকের ঝামেলা এড়িয়ে খুব সহজেই এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করা যায়। ট্রেনের প্রশস্ত ও আরামদায়ক আসন, ক্যাফে কার এবং শান্ত সুন্দর একটি ভ্রমণের মধ্য দিয়ে অনেক চিন্তাশীল কাজ করার সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। অ্যামট্রেক ভ্রমণ পরিবেশবান্ধব। ট্রেনগুলো কম শক্তি খরচ করে এবং গাড়ি বা বিমান ভ্রমণের তুলনায় কম ক্ষতিকারক দূষক উৎপাদন করে। ট্রেনে চড়ে ভ্রমণ আপনার গ্যাস বাঁচাবে এবং আপনার গাড়ির দৈনন্দিন খরচ কমাবে। ট্রেন সফর রাস্তায় এবং আকাশে ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান যানজটও হ্রাস করতে সহায়তা করে।
ট্রেনে ঝামেলা ছাড়াই রোড ট্রিপের আনন্দ উপভোগ করা। গাড়িতে পুরো ট্রিপের জন্য একটি সঙ্কুচিত, অস্বস্তিকর সিটে সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে, ট্রেনে পা প্রসারিত করে বসা এবং ট্রেনের অন্যান্য অংশে ঘুরে বেড়াবার সুযোগ থাকে। প্লেন, বাস বা গাড়ি চালিয়ে ভ্রমণ করার চেয়ে ট্রেনের ভ্রমণ অত্যন্ত আরামদায়ক ও নিরাপদ। এমনকি জীবনের সর্বস্তরের এবং বিশ্বের সমস্ত অংশ থেকে আসা সহযাত্রীদের সঙ্গে চ্যাট বা কথা বলার আনন্দ উপভোগ করা যায় ট্রেনে। ট্রেনের একটি আসনে প্রচুর লেগরুমসহ সুন্দর, প্রশস্ত আসনগুলির মধ্যে একটিতে বিশ্রাম নিতে নিতে প্রকৃতকির অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায় যা অন্য কোনো ভ্রমণেই সম্ভব হয়ে উঠে না।
নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের মধ্যে প্রতি বছর ১৬.৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ট্রেনে যাওয়া আসা করে। কোনো কোনো যাত্রীর কাছে এটা ভ্রমণের মতো মনেই হয় না। হঠাৎ করেই নজরে পড়ল ডেলোওয়ার রিভার। নদীর পাশ দিয়েই ছুটে চলেছে ট্রেন। নদীর উপর বড়বড় মালবাহী জাহাজ চলাচল করছে। নদী পার হয়ে যেতেই হাইওয়ে নজরে পড়ল। শতশত গাড়ি চলছে হাইওয়ের উপর। চলতে চলতেই এক সময় উইলমিংটন স্টেশনে এসে থেমে পড়ল গাড়ি। পাশে বসা নারী যাত্রী ব্যাগ গুছিয়ে নেমে পড়ল স্টেশনে। উঠে দাঁড়ালাম আমি। বাথরুমে যাব। ফ্রেশ হয়ে তারপর অ্যাসেলা ক্যাফে যাব। কফি খেতে হবে।
ট্রেন চলছে আর হাঁটতে হাঁটতে আমি দুলছি। দুলতে দুলতেই ছবি তুলছি। দুলতে দুলতেই এক কম্পার্টমেন্ট থেকে আরেক কম্পার্টমেন্টে পার হয়ে যাচ্ছি। গন্তব্য অ্যাসেলা ক্যাফে। কার নম্বর চার। চলে এলাম অ্যাসেলা ক্যাফে। স্টারবাক্স কফি আর কিছু স্ন্যাকস কিনে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে খেতে শুরু করলাম। স্ন্যাকস শেষ হতেই কফি হাতে আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। ফিরে এলাম নিজের সিট ১২এফ।
অ্যাসেলা ট্রেন ছুটে চলেছে মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর পেন স্টেশনের উদ্দেশে। দেখতে দেখতেই চলে এল বাল্টিমোর পেন স্টেশন। পাশের ট্র্যাকে মেরিল্যান্ড স্টেটের ট্রেন মার্ক দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীদের উঠানামা শেষ হতেই ট্রেন আবারও চলতে শুরু করল যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ইউনিয়ন স্টেশনের উদ্দেশে।
গ্রীষ্মের কী সুন্দর পরিষ্কার নীল আকাশের মাঝে সাদা কুয়াশার ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে সমান্তরালে। তার ফাঁকে ফাঁকেই সূর্য মামার লুকোচুরি খেলা চলছে। পাশের রেল লাইনের দিকে তাকালেই মনে হল দূরন্ত গতিতে দৃষ্টির পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে রেললাইনের লোহার পাতগুলো। মুগ্ধতা আর তৃপ্তি নিয়ে প্রকৃতির রূপ দেখতে লাগলাম অ্যামট্রেক অ্যাসেলা ২১২১ ট্রেনের জানালা দিয়ে।
প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে অবশেষে প্রায় সাড়ে ৫টার দিকে ট্রেনের শেষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ইউনিয়ন স্টেশনে এসে থেমে পড়ল অ্যামট্রেক অ্যাসেলা ২১২১ ট্রেন। যাত্রীদের সঙ্গে আমিও নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। ইউনিয়ন স্টেশনে আমাকে নিতে এসেছে জি আই রাসেল ও জুয়েল বড়ুয়া। স্টেশন থেকে বের হতেই ওদেরকে পেয়ে গেলাম। উঠে বসলাম গাড়িতে।
শিব্বীর আহমেদ: লেখক ও সাংবাদিক
এসএন