বিশ্লেষকদের প্রশ্ন বিএনপি আসলে কী চায়
দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি আসলে কী চায়-রাজনৈতিক অঙ্গনে এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কারণ, বিএনপি কখনো এই সরকারের পদত্যাগ দাবি, কখনো নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা, কখনো নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করা, কখনো সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট নয়, যুগপৎ আন্দোলন করার কথা বলছে। কখনো বলা হচ্ছে প্রধান দাবি খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। এমনকি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী নিয়েও তাদের অবস্থান পরিস্কার নয়।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি এখনো স্থির কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। দলের সিনিয়র নেতারাও একেক সময় একেক কথা বলছেন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর সিলেটে বিএনপির মিডিয়া সেল কর্তৃক আয়োজিত একটি সেমিনারে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গঠনে ‘জাতীয় সরকার ও দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ গঠনের বিষয়টি হঠাৎ সামনে আসার পর বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিএনপির একেক সময় একেক রকম অবস্থান এবং তাদের দাবি দেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা একটা বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে আন্দোলনে নামতে টার্গেট নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। সেখানে বাম-ডান, গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করতে চাই। সেই লক্ষ্যে পরিকল্পনামাফিক কাজ করছি। সব দলের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে ঐক্যের ফরমেট তৈরি করব। আশা করছি, ভালো কিছুই হবে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে দলটির ভেতরে-বাইরে নেতা-কর্মীদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে আসলে কী চায় বিএনপি? রাজপথের আন্দোলনে কতটা সক্ষম দলটি। কেউ কেউ আবার বলছে বিএনপির ঈদের পর আর আসেনি, আন্দোলনও হয়নি।
তবে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে। দলগুলো জানিয়েছে, ক্ষমতায় এলে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনে বিএনপি রূপরেখায় কী উপস্থাপন করে, তার উপর নির্ভর করছে যুগপৎ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ। তারপরও আসলেই কি চায় বিএনপি; হয়তো নিজেরাই সেটা জানে না এমন কথাবার্তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখি আলোচনা চলছে।
তবে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছে-বিএনপির মূল দাবি এই সরকারের বিদায়। এর বাইরে যা কিছু তা সবই পরিবর্তন যোগ্য সিদ্ধান্ত; কোনোটাই চূড়ান্ত নয়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপে মূলত উঠে আসা বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েই জাতীয় সরকার ও দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ বিষয়টিতে বিএনপির ভবিষ্যত রুপরেখাকে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও সুশীল সমাজের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনেরও ঘোষণা দেয় দলটি। একটি কক্ষ বর্তমানে যেভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সেভাবেই হবে। অপরটি কীভাবে হবে তা আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে। দলের গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি সিদ্ধান্তে জনমত তৈরিতে কাজ শুরু করেছে দলটি। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, এ লক্ষ্যে লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে শুরু হয়েছে মতবিনিময়। বিএনপির মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে আট বিভাগীয় শহরে এ সেমিনারের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়। এরই অংশ হিসেবে গত ৯ সেপ্টেম্বর সিলেট বিভাগে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর রংপুর, ২৪ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পরবর্তী সেমিনার হবে। ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ, ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম, ১৫ অক্টোবর বরিশাল, ২২ অক্টোবর খুলনা ও ২৯ অক্টোবর ঢাকা বিভাগে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলন ও দাবিগুলোর মধ্যে প্রধান দাবি হচ্ছে এই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা। সেই লক্ষ্যে সরকার হটানোর যুগপৎ আন্দোলনের রুপরেখা শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে আমরা কাজ করছি এবং দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের প্রেক্ষিতে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গৃহীত হয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিএনপি তথা দেশের মানুষের দাবি ও লক্ষ্য একটাই সেটি হচ্ছে; এই আওয়ামী লীগ সরকারকে সরে যেতে হবে। তাদেরকে মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে চায় না। তাই এদের অধীনে আগামীতে কোনো নির্বাচন নয়।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি যা করছে প্রকাশ্যে করছে, ঘোষণা দিয়ে করছে এখানে তো লুকোচুরির কিছুই নাই। বিএনপির উল্লেখিত দাবিগুলো না বোঝার কিছু নাই। এতটুকু রাজনৈতিক জ্ঞান না রেখে অবান্তর প্রশ্ন করারও কিছু নাই।’
এই বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বলেছেন, ‘আমাদের মূলকথা অনেক আগেই বলেছি যে, একটি সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। এই সংসদ বাতিল করতে হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, তাদের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। তারা সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোটের পরিবেশ তৈরি করবে যাতে ভোটাররা পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে দিনে ভোট দিতে পারেন। তার সঙ্গে আমাদের নেতা (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান) বলেছেন, নির্বাচনের পরে আন্দোলনকারী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। প্রধান কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে সেগুলোকে এককভাবে গড়ে তোলাটা যুক্তিসঙ্গত হবে না, তাই অন্যান্য দলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই।’
এনএইচবি/এমএমএ/