মেট্রোরেলের যুগে বাংলাদেশ
২০০৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় মেট্রোরেলের কথা বলা হলেও সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ২০০৮ সালে। ২০১২ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মেট্রোরেল লাইন-৬ (উত্তরা থেকে কমলাপুর) নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন পায়। কিন্তু বিজয় সরণি অংশে মেট্রোরেল কোন পথ দিয়ে যাবে তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। প্রথমে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের সামনে দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়ার কথা ছিল। সেটা নিয়ে বিমানবাহিনী আপত্তি জানায়। পরে পথ পরিবর্তন করে মেট্রোরেল জাতীয় সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে ফার্মগেটে নেওয়া হয়।
মেট্রোরেল নির্মাণে কারিগরি ও ঋণসহায়তা দিয়েছে জাপান। দেশটির উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সঙ্গে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ঋণ চুক্তি করে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। একই বছর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় মেট্রোরেলের ৭ পরামর্শক নিহত হন। এরপর কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরে মেট্রোরেলের জন্য বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ দেওয়া হয়। কাজ শুরু হয় আবার। কিন্তু করোনা মহামারিতে নির্মাণকাজ বিঘ্নিত হয়।
বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) বেলা ১১টা ৫ মিনিটে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের সি-১ ব্লকের খেলার মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফলক উন্মোচন করে মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন।
ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় নতুন যুগ শুরু হলো মেট্রোরেল। রাজধানীতে প্রথমবারের মতো যাত্রী নিয়ে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হবে। মাত্র ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে উত্তরা থেকে আগারগাঁও চলে আসা যাবে। রাজধানীর লক্কড়ঝক্কড় ও জীর্ণ বাসের বিপরীতে জাপানে তৈরি মেট্রোরেলের কোচগুলো অত্যাধুনিক। তিনতলা মেট্রোরেল স্টেশনে উঠা-নামার জন্য সিঁড়ি, চলন্ত সিঁড়ি (এসকেলেটর) ও লিফট রয়েছে। ট্রেন ও স্টেশন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি)।
উত্তরায় সুধীসমাবেশ শেষ করে দিয়াবাড়ি (উত্তরা) স্টেশন থেকে মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রী নিয়ে আগারগাঁওয়ের দিকে রওনা দেবে।
প্রথম যাত্রার যাত্রী হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার সদস্য ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। সাধারণ যাত্রীরা অবশ্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) সকাল ৮টা থেকে মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন।
এটি বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রেন, চলবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে। প্রথম যাত্রায় ট্রেনটি চালাবেন একজন নারী চালক, নাম মরিয়ম আফিজা এবং প্রথমবারের মতো যাত্রীরা ভাড়া পরিশোধ করবেন কার্ড দিয়ে। উড়ালপথের প্রথম ট্রেনও মেট্রোরেল।
ট্রেনের যাত্রীরা একদিকের দরজা দিয়ে উঠবেন এবং নামবেন অন্যদিক দিয়ে। শেষ স্টেশনে সব যাত্রীকে নেমে যেতে হবে। অর্থাৎ কেউ ট্রেনে অবস্থান করতে পারবেন না। নতুন করে কার্ড ছুঁইয়ে (পাঞ্চ করে) ট্রেনে উঠতে হবে। প্রতিটি স্টেশনে যাত্রীদের নিরাপত্তা প্ল্যাটফর্মে দরজাযুক্ত বেড়া আছে। স্টেশনে এসে ট্রেনের দরজা বেড়ার দরজা বরাবর খুলে যাবে। এরপর যাত্রীরা ট্রেনে উঠতে-নামতে পারবেন।
মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া ৬০ টাকা। স্থায়ী কার্ড কিনে যাতায়াত করলে ১০ শতাংশ ছাড় আছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিনামূল্যে যাতায়াত করতে পারবেন। পঙ্গুদের জন্য ছাড় আছে ১৫ শতাংশ। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া বা হাফ পাসের ব্যবস্থা নেই, যেটা বাসে রয়েছে।
মেট্রোরেলে ভ্রমণের জন্য দুই ধরনের টিকিট রাখা হয়েছে- ১০ বছরের স্থায়ী কার্ড ও এক যাত্রার (সিঙ্গেল জার্নি) কার্ড। স্থায়ী কার্ডের জন্য লাগবে ২০০ টাকা, যা নিরাপত্তা জামানত। এই কার্ডে ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনমতো টাকা ভরতে (রিচার্জ) হবে। কেউ কার্ড ফেরত দিলে জামানত ফেরত পাবেন। হারিয়ে ফেললে টাকা দিয়ে নতুন করে কার্ড কিনতে হবে। এতে পুরোনো কার্ডে টাকা থাকলে তা অবশ্য নতুন কার্ডে যুক্ত হবে। স্থায়ী কার্ড কেনার আগে নিবন্ধন করতে হবে। এজন্য নিজের নাম, মা-বাবার নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) লাগবে। পাসপোর্টের নম্বর হলেও চলবে। এসব তথ্য জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্যভান্ডারের সঙ্গে মিলতে হবে। নইলে কার্ড পাওয়া যাবে না। স্থায়ী কার্ড নিজের কাছেই থাকবে। একক যাত্রার কার্ড ভ্রমণ শেষে যন্ত্রের ভেতরে দিলে তবেই বের হওয়ার পথ খুলবে।
মেট্রোরেলের প্রথম পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালে। রাজধানীর জন্য তৈরি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) বলা হয়েছিল মেট্রোরেলের কথা। এরপর মাস গেছে, বছর গেছে, যুগ গেছে, মানুষের অপেক্ষা শুধু বেড়েছে। ২০১৬ সালে দেখা গেল, বেগম রোকেয়া সরণিতে সড়কের মাঝখানে কংক্রিটের ব্লকের বেড়া দিয়ে শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের কাজ। ছয় বছর পর মেট্রোরেল এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি পথে মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে, যা লাইন-৬ নামে পরিচিত। এর মধ্যে আজ চালু হতে যাওয়া উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দূরত্ব পৌনে ১২ কিলোমিটার।
প্রথম মেট্রোরেল চালক এক নারী
মেট্রোরেলের চালকের আসনে বসবেন মরিয়ম আফিজা। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোরেল (লাইন–৬) পরিদর্শন করে মরিয়ম আফিজাকে অভিনন্দন জানান জাইকার প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকা।
এমএইচ/এসজি