রোহিঙ্গা, ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ ও পরাশক্তিগুলোর টানাহেঁচড়া ছিল বছরজুড়ে

বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও ‘বিদেশি হস্তক্ষেপের’ মতো বিষয়। এ ছাড়া, নিজেদের জোটে যোগ দিতে বাংলাদেশকে নিয়ে পরাশক্তিগুলোর টানাহেঁচড়াও ছিল বছর জুড়ে আলোচিত।
বছরের শুরু থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। চলতি বছরেই মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছর পূর্তি হয়েছে। এক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলো বছর জুড়েই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন প্রত্যাবাসনে পরাশক্তিগুলোর আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছেন না জানিয়ে বারবার বক্তৃতায় বলেছেন, এসব দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও গত ৫ বছরে ১৫ থেকে ২০০ গুণ পর্যন্ত ব্যবসা বাড়িয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে। শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যই ২০০ গুণ ব্যবসা বাড়িয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনকে ফোন করে অনুরোধ জানিয়েছেন এসব না বলার জন্য। এমন ফোনালাপের কথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়ে বলেন, তারা চান না আমি এসব বলি।
রোহিঙ্গা নিয়ে যখন এই অবস্থা তখন দেখা গেল মিয়ানমার থেকে দফায় দফায় মর্টারশেল এসে পড়ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। এসব ঘটনায় বাংলাদেশ মোট ৪ দফা ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানায়। এ ছাড়া, ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন ড. মোমেন।
বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আর এক বছর আছে। এ সময় নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন বছড়জুড়েই। যদিও সরকার বিষয়টিকে ভালভাবে নেয়নি।
কূটনীতিকদের এসব ‘হস্তক্ষেপের’ মধ্যে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির ‘বাংলাদেশের গত নির্বাচনে আগের রাতেই পুলিশ ব্যালটপেপার পুলিশ ভরে রেখেছিল’ শীর্ষক বক্তব্য। এর পরপরই প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর স্থগিত হয়ে যায়।
তবে প্রধানমন্ত্রীর সফর স্থগিত হওয়া নিয়ে দুদেশের কর্মকর্তারাই বলেছেন, এটা সাময়িক। উপযুক্ত সময়ে সফর হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সফর আমরাই স্থগিত করেছি। কারণ ওই দেশে (জাপানে) এখনো কোভিড ভয়াবহ আকারে রয়ে গেছে।
বিদেশি হস্তক্ষেপের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হিসেবে অভিযোগ করা হচ্ছে বিএনপির নিখোঁজ এক নেতার শাহিনবাগের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে। সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গেলে খুশি হতাম।
শাহিনবাগের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন যান তখন ‘মায়ের কান্না’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে কিছু লোক তাকে স্মারকলিপি দিতে যান। এ নিয়ে পিটার হাস পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করে বলেন, তার নিরাপত্তায় ঘাটতি দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
যদিও সরকার দাবি করেছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তায় কোনো কমতি নেই। এমন ঘটনায় ওয়াশিংটন থেকেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে ফোন দিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা জোরদার করার দাবি জানান।
বিদেশিরা বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করছেন এমন অভিযোগ তুলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বার বার বলেছেন, তাদের মনে রাখতে হবে আমরা উপনিবেশ না। আমরাও স্বাধীন। এমন করলে বিদেশি দূতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেন, আপনারা বন্ধুত্ব নষ্ট করবন না। বন্ধু আছেন বন্ধু থাকুন।
বাংলাদেশ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর টানাহেঁচড়া
সংশ্লিষ্টরা জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বাকি মিত্ররা চায় বাংলাদেশ সামরিক জোট ‘কোয়াড’ ও ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস) যোগ দিক। অন্যদিকে, চীন চায় বাংলাদেশ তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে (জিডিআই) যোগ দিক।
বাংলাদেশ যদিও কোনো দিকেই যোগ দেয়নি। নানাভাবে ‘ব্যালান্স করছে’ এখন পর্যন্ত। এমন অবস্থায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফরে আসেন।
তার সফরের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, চীন জিডিআইতে যোগ দিতে বলেছিল। আমরা বলেছি, কাগজপত্র দেন। পড়ে দেখি। তারপর সিদ্ধান্ত জানাই।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের ঠিক আগে ঢাকায় আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। সফরকালে তিনি বাংলাদেশকে কোয়াড ও আইপিএসে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেন ইস্যুতেও পাশে পেতে বাংলাদেশকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে রাশিয়া চায় বাংলাদেশকে তার পক্ষে ভোট দিক আর যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ ইউক্রেনের পক্ষে থাকুক।
এই টানাহেঁচড়ার চূড়ান্ত বহিপ্রকাশ দেখা যায় সম্প্রতি। রাশিয়া একটি টুইট করে এবং পরবর্তীতে মস্কোতে পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, রাশিয়ার এমন মনোভাব ইউক্রেনের বেলায় কোথায় ছিল?
আরইউ/এমএমএ/
