মন্ত্রিসভা বৈঠক
শাস্তি ও জরিমানার বিধান রেখে পরিষেবা আইন অনুমোদন

সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে সরকার ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন ২০২২’-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রস্তাবিত এই আইনটি পাস হলে বেআইনিভাবে অত্যাবশ্যক সেবা খাতে বেআইনি ধর্মঘট ডাকলে বা সমর্থন দিলে কিংবা অযৌক্তিকভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান লে-অফ ঘোষণা করলে সাজার মুখোমুখি হতে হবে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী সরকার যেটিকে অত্যাবশ্যক মনে করবে সেগুলোকে অত্যাবশ্যক পরিষেবার আওতায় নিতে পারবে।
সোমবার (৩১ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাবিত আইনটির খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।২০২১ সালের ৪ অক্টোবর মন্ত্রিসভা এই আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল।
বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, দ্য অ্যাসেনশিয়াল সার্ভিসেস মেনটেইনেন্স অ্যাক্ট ১৯৫২ এবং দ্য অ্যাসেনশিয়াল সার্ভিসেস অর্ডিনেন্স ১৯৫৮ কে একসঙ্গে করে যুগোপযোগী করে অত্যাবশক পরিষেবা আইন ২০২২ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনটিতে ১৪টি ধারা আছে। এরমধ্যে ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সরকার কোনগুলোকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করবে।
প্রস্তাবিত আইনের বিভিন্ন ধারায় বলা হয়েছে, কতিপয় চাকরিতে কর্মরতদের নির্দিষ্ট এলাকা ত্যাগ না করার আদেশ প্রদানের ক্ষমতা, ধর্মঘট, লকডাউন বা লে-অফ নিষিদ্ধ করার কথা। অনেক সময় শিল্প প্রতিষ্ঠানে লে-অফ করা হয়। সরকার যদি মনে করে এগুলো জাস্টিফায়েড না তাহলে এগুলো নিষিদ্ধ করতে পারবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যে সেবাগুলোকে সরকার মনে করবে অত্যাবশ্যক পরিষেবা সরকার সেগুলোর নাম ঘোষণা করবে। কয়েকটি সেবার নাম এখানে উল্লেখ করা আছে। যেমন ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্যও প্রযুক্তি, ই-কমার্স, অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল সেবা। সরকার মনে করে, এই সেবাগুলো কেউ যখন খুশি তখন বন্ধ করে দিতে পারবে না।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল আর্থিক সেবা যেমন মোবাইল আর্থিক সেবা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, সরবরাহ, বিপণন এবং গ্যাস ও কয়লা। এগুলো অত্যাবশ্যক সেবা। এগুলোর বিষয়ে যদি কোনো অচলাবস্থা তৈরি হয় সেক্ষেত্রে সরকার ইন্টারফেয়ার করতে পারবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কল্যাণে সরকার যেভাবে নির্দেশ দেবে সেভাবে পরিচালিত হতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, স্থল, জল, রেল ও আকাশপথের যাত্রী বা পণ্য পরিবহন সেবাও অত্যাবশ্যক পরিষেবা বলে পরিচিত হবে। স্থল, সমুদ্র, নদী বা বিমানবন্দরের পণ্য খালাস, সশস্ত্র বাহিনীর পরিচালনায় কোনো প্রতিষ্ঠান বা এ সংক্রান্ত পরিষেবা। এর বাইরেও সরকার যদি মনে করে কোনো সেবাকে অত্যবশ্যক সেবা ঘোষণা করতে পারবে।
তিনি বলেন, আইনটির খসড়া অনুযায়ী, দেশের প্রতিরক্ষার উদ্দেশে প্রয়োজনীয় পণ্য বা মালামাল উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা; খাদ্যদ্রব্য ক্রয়, বিক্রয়, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মজুত বা বিতরণ কাজে নিযুক্ত সরকারি মালিকানাধীন বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা; হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যসেবা বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান এবং ডিসপেনসারি সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা; ওষুধ উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয় বিক্রয়সহ এসব কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা কারখানার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিষেবা; তেলক্ষেত্র, তেল শোধনাগার, তেল সংরক্ষণ এবং পেট্রোলিয়াম বা পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা এবং টাকশাল ও নিরাপত্তামূলক মুদ্রণ কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিষেবাকে সরকার গেজেট দিয়ে অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।
এর বাইরেও জনকল্যাণমূলক সেবা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমন সেবা; জননিরাপত্তা বা জনগণের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ সেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমন সেবাকেও অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ঘোষণা করতে পারবে।
জনগণের অসহনীয় কষ্টের কারণ হলে বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এবং দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারা দেশে বা দেশের কোনো অংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ছয় মাসের জন্য কোনো চাকরি বা কোনো শ্রেণির চাকরি সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিষেবাকেও সরকার ছয় মাসের জন্য অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। প্রয়োজনে এর মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো যাবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যদি কেউ এ জাতীয় অপরাধ করে তাহলে সাধারণ ভাবে ৬ মাসের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। আবার বেআইনি ধর্মঘট চলমান রাখার জন্য যদি সমর্থন দেয় তাহলে এক বছরের কারাদণ্ড ও অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। অনেকগুলো অপরাধের কথা এখানে বলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের মালিক যদি বেআইনি লে-আউট চালু করে সেক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৬ মাস জেল ও অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দেওয়া যাবে। কেউ যদি প্ররোচনা দেয় তাহলে মূল অপরাধে যে শাস্তি সেই শাস্তিই পাবে। বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে যদি সরকারি কোনো অফিস হয়। যেমন কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের এমডি যদি লে অফ ঘোষণা করেন তাহলে এর বাইরেও ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং হবে।’
কিছু কিছু চাকরিতে থাকা কর্মরতদের সরকার নির্দেশ দিতে পারবে যে, সরকারের নির্দেশ ছাড়া তারা দেশত্যাগ করতে পারবে না। বিধিতে এগুলো পুরো থাকবে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গাছ কাটা যাবে না
দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সরকার দেশের সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে গাছ কাটার উপর ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রিসভায় উত্তাপন করা হলে মন্ত্রিসভা তাতে সায় দেয়।
যত্রতত্র বালু উত্তোলন করা যাবে না
বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন ২০২২ এর খসড়াও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জনান,এই আইনের মূল কথা হচ্ছে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, প্রত্যেকটি বালু মহালের জন্য তারা পানি উন্নয়ন বোর্ড বা বিআইডব্লিউটিএ কে বলবে, তাদের আওতায় কোথায় বালু মহাল আছে, তার পরিধি, কি পরিমানের বালু উত্তোলন করা যাবে। এই বালু মহালগুলো এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া যাবে। এর বেশি দেওয়া যাবে না। তবে কোনো উর্বর জমি বা কৃষি জমি থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে না।
এছাড়া জেলা প্রশাসকরা যদি মনে করেন কোথাও বালু মহাল আছে, সেক্ষেত্রে তারা পানি উন্নয়ন বোর্ড অথবা বিআইডব্লিউটিএ কে বলজে ওই বালু মহালের পরিমাপ করে দিতে। তারা সেটা করে দেওয়ার পর বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দিতে পারবে। ছোট বালু মহাল হলে সেটা ছয় মাসের জন্য দিতে পারবে। তবে কোনোভাবেই কোনো মহাল এক বছরের বেশি ইজারা দেওয়া যাবে না। আর সার্ভে রিপোর্ট অবশ্যই জেলা প্রশাসকের ওয়েবসাইটে দিয়ে দিতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এখন আর রাতের বেলা উত্তোলন করা যাবে না। বালু উত্তোলন করতে হবে সূর্যাস্তের মধ্যেই। যারা বে-আইনিভাবে বালু উত্তোলন করলে তার লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল করা হবে। সে আর কোনোদিন বালু উত্তোলন করতে পারবে না।
তিনি বলেন, কোনো অনুমোদন ছাড়াই যত্রতত্র জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। এটা বন্ধ করতেই এই আইন সংশোধন করা হয়েছে।
এনএইচবি/এমএমএ/
