বাংলাদেশে গুমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ভুল তথ্য
জাতিসংঘ বাংলাদেশে ‘জোর করে গুমের’ শিকার ৭৬ ব্যক্তির যে তালিকা প্রকাশ করেছে সেটি আন্তর্জাতিক সংস্থাটির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তালিকায় থাকা ৭৬ জনের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশে বসবাস করছে আবার তালিকাতে পলাতক আসামির নামও রয়েছে। এ কারণে যেই এনজিওগুলোর উপর নির্ভর করে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে সেই এনজিওসহ প্রশ্ন উঠছে খোদ জাতিসংঘের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে।
অনেক বিশেষজ্ঞ এমনও মন্তব্য করছেন, ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতিত্ব করা এনজিওগুলোর উপর জাতিসংঘের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাই এ ধরনের ভুলের জন্য দায়ী।
বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রকাশিত তালিকায় মণিপুর-ভিত্তিক চরমপন্থি গ্রুপ ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (ইউএনএলএফ) চেয়ারম্যান সানায়াইমা রাজকুমারের নাম রয়েছে। যিনি মণিপুরের শীর্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। তিনি ভারতে নির্দিষ্ট সময় জেল খেটে বর্তমানে বাংলাদেশে তার পৈতৃক বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন।
ইউএনএলএফ চেয়ারম্যান যার আসল নাম রাজকুমার মেঘেন (সানাইয়ামা তার দলের উপনাম) বিএনপি-জামাত শাসনামলে এবং সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে সক্রিয় হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিদ্রোহীরা যেন বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে না পারে, সে জন্য দীর্ঘ অভিযান চালান। এ সময় রাজকুমার মেঘেন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে নেপালে আশ্রয় নেন। এ সময় বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করে।
‘ভারতে বৈধভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর' জন্য তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেখানে ১০ বছর সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর গুয়াহাটির কারাগার থেকে মুক্তি পান রাজকুমার মেঘেন। বর্তমানে তার বয়স ৭৮ বছর। তিনি এখন তার স্ত্রী ইবেংমুন্সি দেবী, ছেলে মেই চিংলেন এবং পুত্রবধূ বৃন্দার সঙ্গে তার পৈতৃক বাড়িতে থাকেন। তার নামও রয়েছে জাতিসংঘের এই গুম হওয়া মানুষের তালিকায়।
প্রশ্ন হলো— জাতিসংঘের একটি গ্রুপ কীভাবে এত বড় ভুল করতে পারে? উত্তরটি সহজ— তারা শুধুমাত্র স্থানীয় বাংলাদেশ-ভিত্তিক এনজিওদের দ্বারা সরবরাহকৃত গুমের ঘটনাবলীকে তথ্য যাচাই না করেই প্রকাশ করেছে।
২০১০ সালে কিছু অপ্রমাণিত মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মেঘেনকে বাংলাদেশ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল এবং নীরবে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে। যে অভিযোগ সে সময় ঢাকা ও দিল্লি উভয়ই অস্বীকার করে। মেঘেন, তার বিচারের সময় বিহারে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এই তথ্যের বিরোধিতা করেননি। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, ২০১০ সালের আগে বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যান তিনি এবং মণিপুরে তার যোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পাচার করেছিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বাংলাদেশে অস্ত্র নিয়ে আসার চেষ্টাও করেন তিনি।
জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিবেদনে কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র ওরফে চিলহেইবাকে বাংলাদেশে গুমের শিকার হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নবচন্দ্র ইউএনএলএফ সশস্ত্র শাখার একজন 'প্রধান'। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ডাউকির কাছে সিলেট-মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় গ্রেপ্তার করা হয় চিলহেইবাকে।
মণিপুরের কিছু স্থানীয় মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে যে নবচন্দ্রকে ঢাকায় বাংলাদেশ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং নীরবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের কাছে হস্তান্তর করেছে। যে অভিযোগ ভারত সরাসরি অস্বীকার করেছে। নবচন্দ্রকে ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ মণিপুর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল এবং এখন বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, সশস্ত্র উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান ছিল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের প্রতি শেখ হাসিনার অঙ্গীকারের অংশ।
এ বিষয়ে লেখক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, 'ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের পাশাপাশি এই বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিয়েছিল বিএনপি-জামাত সরকার। আর এ কারণে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সম্ভবত বিরক্ত। তাই তারা হাসিনা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য মেঘেন এবং নবচন্দ্রের মতো লোকদের জোরপূর্বক গুমের শিকার হিসেবে পাশ কাটিয়ে যেতে শুরু করে।'
প্রকৃতপক্ষে, জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ তথ্যের জন্য, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদিলুর রহমান খান শুভ্র দ্বারা পরিচালিত অধিকারের মতো বিতর্কিত এনজিওর ওপর নির্ভরশীল ছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো অন্যান্য অনুরূপ সংস্থাগুলিও বিচার চলাকালীন স্ব-স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে 'ওকালতি' এর জন্য অভিযুক্ত হয়েছে।
এমনকি যখন উগ্রপন্থী হেফাজতে ইসলাম জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মেয়েদের শিক্ষা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিল এবং পশ্চিমাদেরকে 'কাফের' বা 'নাস্তিক' বলে আখ্যায়িত করে তাদের ক্যাডাররা ২০১৩ সালে ঢাকার রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন এই উগ্রপন্থী গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা দেয়া হলে অধিকার 'বহু হতাহতের' তথ্য প্রকাশ করে, যা শেষ পর্যন্ত মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, 'কিন্তু মেঘেনের মতো এই ধরনের বানোয়াট গুমের তথ্য গ্রহণ করা জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের জন্য নিছক লজ্জাজনক। বিদ্রোহী নেতা যখন ভারতে গ্রেপ্তারের পর বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন তখন তারা কীভাবে কাউকে নিখোঁজ হিসাবে তালিকাভুক্ত করতে পারে সে সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে। মেগান বা নবচন্দ্র কেউই কোনো বৈধ কাগজপত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেননি। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে তারা অস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশে ফিরে আসে। তাহলে কীভাবে জাতিসংঘের মতো একটি আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থা এই বিষয়ে আওয়াজ তোলে, যখন তাদের দুজনেরই ভারতীয় নাগরিকত্ব রয়েছে?
গত ডিসেম্বরে জেনেভায় এনফোর্সড ডিসপিয়ারেন্স বিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বলে, বাংলাদেশে ৭৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। গ্রুপটি গুমের মামলাগুলো তদন্তেরও আহ্বান জানায়। সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে
আরএ/