পদ্মা সেতুর বিরোধীতা করে কে কী বলেছিলেন, জানালেন প্রধানমন্ত্রী
দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সড়ে যায় তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন কারো টাকা লাগবে না, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করব। তার সেই ডাকে দেশবাসী ব্যাপক সাড়া দিয়েছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তবে তখন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসন ও বুদ্ধিজীবীরা সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে উপহাস করে নানা কথা বলেছিলেন।
বুধবার (২২ জুন) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পদ্মা সেতু ইস্যু ও সমসমায়িক ইস্যু নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তখন কে কী বলেছিলেন তা তুলে ধরেন সরকার প্রধান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু লোক অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল, যেটা আমরা করতে দেইনি। প্রাক যোগ্য ঠিকাদার বাতিল করতে বলে বিশ্বব্যাংক। একইসঙ্গে তারা একটি অযোগ্য ঠিকাদারকে যোগ্য করতে বলে যেটা রাজি হইনি।’
নিজের অর্থায়নে করবো ঘোষণা দিয়েছিলাম তখন কে কী বলেছিলেন তা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির নেত্রী ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচানায় বলেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার, কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান ২০১২ সালের ১ জুলাই বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে পরবর্তী ঋণ সহায়তা পাওয়া খুব দুষ্কর হয়ে পড়বে। যখনই কোনো দাতা সংস্থা কোনো নতুন প্রকল্পে আগ্রহ হয়ে উঠবে, দুর্নীতির কারণে তারা বাংলাদেশকে ভিন্ন চোখে দেখবে। সরকার যদি বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা শুরু করে ফলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে পদ্মা সেতুর মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী তার জবাবে বলেন, ‘আশা করি পদ্মা সেতুর মান নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থায়ন বাতিল করল।’ জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়া নিজেই ভুলে গেছেন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্লান্টের অর্থায়ন বিশ্বব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছিল দুর্নীতির কারণে, সেই দুর্নীতির সঙ্গে তিনি এবং তার পুত্ররা জড়িত ছিলেন। সিমেন্স কোম্পানি এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল এটা এফবিআই বের করেছিল।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি যে আমাদের পেছনে টেনে বেড়াচ্ছে এবং দেশের উন্নয়নের ধারাকে নষ্ট করছে এটা তারই আর একটি উদাহরণ।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মামলা করেও কিন্তু দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারে নাই। কিন্তু তারা দুর্নীতি দেখেছে।‘
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আলী আহসান মনসুর বলেন,‘বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে দু:খজনক আখ্যায়িত করে বলেন, ‘সুশাসনের অভাবে দেশে সর্ববৃহৎ প্রকল্প আজ অনিশ্চয়তার মুখে।’ প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন দুর্নীতিটা কোথায় দেখলেন?
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিকল্প উৎস হতে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দৃষ্টি সড়ানোর উপায় বলে মনে হতে পারে। যদি এই সিদ্ধান্ত সফলও হয় তাতেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না বিচার করবেন দেশের জনগণ।
বিএনপি সরকারের মন্ত্রী প্রয়াত এমকে আনোয়ার বলেন, ‘নিজস্ব অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের নাই।’
সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন বলেছেন, ‘নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করেছেন তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, তবে সরকার ইচ্ছা করলে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে পারবে কিন্তু শেষ করতে পারবে না। আমি তাকে দাওয়াত দিতে চাই তিনি যেন পদ্মা সেতু দিয়ে পার হন।
আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি সব সময় স্বাধীন থাকেন, স্বাধীনভাবে কথা বলেন। ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘পদ্মা সেতু দেশীয় অর্থায়নে হবে না, সম্ভব নয়।’ আজ সেটা সম্ভব হয়েছে তাকেও দাওয়াত দিচ্ছি।
২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারলেও শেষ করার গ্যারান্টি থাকবে না ‘ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শেষ করেছি।’
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘এতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন যার যোগান দিতে বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ পড়বে। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না।’ জবাবে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের রিজার্ভ কিন্তু এখনও ৪২ বিলিয়ন, বৈদেশিক মুদ্রায় চাপ পড়েনি।’
সিপিডির আরেক ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু শুরু করা হলে দেশের অন্য সব কাঠামো উন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করা যেত সেগুলো আর হবে না।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব কাজগুলো কিন্তু চলছে কোনটা কিন্তু থেমে যায়নি। এসব বিশিষ্টজনদের উদ্দেশে করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি না কেন এদের ভেতরে আত্মবিশ্বাসের অভাব। তারা ভুলে যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ডাকে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে, আমরা বিজয়ী জাতি। আমরা যখন একটা কথা বলি ভেবে চিন্তে বলি। বিজয়ী জাতি হিসেবে সেই মানসিক শক্তি নিয়েই কথা বলি। কিন্তু ওনাদের ভেতরে একটা পরাজিত মনোভাব। মনে হয় যেন পাকিস্তানি আমলের এই প্রদেশে একটা পরাধিনতার গ্লানি তারা সব সময় সেই আত্ম গ্লানিতে ভোগেন, তাদের আত্ম বিশ্বাসের অভাব। কিন্তু আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে আমি যেটা পারব সেটাই বলব, যেটা বলব সেটা আমি করব। সেটা আমি করে দেখাতে পারি, সেটা আমরা করেছি এ জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ।
এসএম/এমএমএ/