যাত্রী কল্যাণ সমিতি
ঈদের আগে-পরে ১৫ দিনে দুর্ঘটনায় নিহত ৪১৬
ঈদযাত্রা শুরুর দিন ২৬ এপ্রিল থেকে ঈদ শেষে কমস্থলে ফেরা ১০ মে পর্যন্ত ১৫ দিনে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া এ সময় ৮৪৪ জন আহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার (১২ মে) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো দশমিক মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২২ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা বহুল প্রচারিত ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইন দৈনিক এ প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত ও ১১০ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, নিহতের ৩৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং আহতের ১৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ প্রায়।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক, রেল ও নৌ-পথে সম্মিলিতভাবে ৪০২টি দুর্ঘটনায় ৪৪৩ জন নিহত ও ৮৬৮ জন আহত হয়েছেন।
এবারের ঈদে করোনা মুক্তির কারণে বেশি মানুষের যাতায়াত করেছে মন্তব্য করে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিগত ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরে যাতায়াতের সঙ্গে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ, নিহত ২২ দশমিক ৩৫ শতাংশ, আহত ২৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে। উল্লেখিত সময়ে রেলপথে ২৭টি ঘটনায় ২৫ জন নিহত ও চারজন আহত হয়েছে। নৌ-পথে তিনটি দুর্ঘটনায় দুইজন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন।
এ সময় সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ২০৯ জন চালক, ২৪ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮৮ জন পথচারী, ৬২ জন নারী, ৩৫ জন শিশু, ৩৩ জন শিক্ষার্থী, দুইজন সাংবাদিক, আটজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, দুইজন শিক্ষক, ছয়জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, দুইজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন চিকিৎসকের পরিচয় মিলেছে।
এর মধ্যে নিহত হয়েছেন দুইজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন পুলিশ সদস্য, দুইজন ডিজিএফআই সদস্য , একজন সেনাবাহিনীর সদস্য, দুইজন নৌবাহিনীর সদস্য, ৩৫ জন নারী, একজন চিকিৎসক, ২৫ জন শিশু, ২৫ জন শিক্ষার্থী, দুইজন শিক্ষক, ১২৫ জন চালক, ১২ জন পরিবহন শ্রমিক, ৬০ জন পথচারী, পাঁচজন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী।
সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ৩৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ অটোরিকশা, ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল ও ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ বাস এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
সংঘটিত দুর্ঘটনার ২০ দশমিক ৯৬ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪২ দশমিক ৪৭ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ১৫ দশমিক ৩২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে, ১ দশমিক ০৭ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষ ও শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এ ছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ২ দশমিক ৪১ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার এ চিত্রকে একটি প্রতীকী চিত্র বলা চলে। প্রকৃতপক্ষে দেশে বর্তমানে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক ক্যান্সারের মতো বেড়ে যাওয়ার কারণে পঙ্গু হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ পঙ্গু রোগী ভর্তি হলেও ঈদের এই সময়ে ২০০ থেকে ২৫০ জন হারে প্রতিদিন রোগী ভর্তি হয়েছে। যার ৬০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৫ শতাংশ ইজিবাইক দুর্ঘটনায় শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ২ শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। দেশের বিভাগীয় হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। জেলা সদর হাসপাতালেও আক্রান্ত রোগীর যে ধরনের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের চিত্র সংবাদপত্রে উঠে আসে না বলেই আমরাও এ ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরতে পারি না।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, প্রতি বছর ৫ লাখ মোটরসাইকেল বিপণন করে ব্যবসায়ীরা ৫ হাজার কোটি টাকা আয় হলেও দুর্ঘটনায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এ বাহন কখনো গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। এবারের ঈদে যারা মোটারসাইকেল ব্যবহার করেছে তারা রাইড শেয়ারিং নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে।
দুর্ঘটনার কারণসমূহ :
১. জাতীয় মহাসড়কে ঈদযাত্রার বহরে মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার।
২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ঈদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকদের রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো।
৩. জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টানিং চিহ্ন না থাকার ফলে নতুন চালদের এসব সড়কে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে।
৪. মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা।
৫. উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাদাঁবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন।
৬. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, বেপরোয়া যানবাহন চালানো।
দুর্ঘটনার প্রতিরোধে সুপারিশসমূহ :
১. জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা।
২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা।
৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ত্রুটি সারানোর উদ্যোগ গ্রহণ।
৪. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
৫. সড়কে চাদাঁবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা।
৬. সড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা।
৭ . সড়ক পরিবহন আইন যথাযতভাবে বাস্তবায়ন করা। ট্রাফিক আইনের অপপ্রয়োগ রোধ করা।
৮ . গণপরিবহন বিকশিত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
মানসম্মত সড়ক নিমাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা।
আরইউ/এসএন