ইভিএমে কি আসলে ভোট কারচুপি করা যায়?
নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) উত্তম মাধ্যম বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক মহলে ইভেএমের পক্ষে-বিপক্ষে যে আলোচনা সেটা রাজনৈতিক আলোচনা। প্রকৃতপক্ষে ইভিএমে ভোট কারচুপি করার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে কোথাও কেন্দ্র দখল বা বুথ দখল হলে সেই দায় ইভিএমের নয় বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা যতই এগিয়ে আসছে ততই ভোটের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা সরগরম হচ্ছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দেওয়া বক্তৃতায় বলেছেন আগামী নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে হবে। তার সেই বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগ নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে আশ্বস্ত নয় অন্যতম বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তারা বলছে ইভিএম কেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবে না।
ক্ষতাসীন আওয়ামী লীগসহ তাদের শরীকরা ইভিএমের প্রতি আস্থাশীল থাকলেও বিএনপিসহ তাদের অনুসারীরা এর চরম বিরোধিতা করে আসছে। তাদের দাবি যেখানে যার ক্ষমতা বেশি সেখানে তাদের লোক দাঁড়িয়ে ইভিএমের বোতাম চেপে ভোটের চিত্র পাল্টে দিতে পারে। সেই সুযোগ ইভিএমে রয়েছে।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ইভিএমের ব্যবহার দেখা গেছে। ভোটের নিউজ কাভার করতে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় ইভিএমে ভোট গ্রহণে গতি কম ছিল। একজনের ভোট আর একজন দিয়েছে এরকম খবর পাওয়া যায়নি। তবে অনেকে অভিযোগ করেছেন আগেই বোতাম চেপে ভোট দিয়ে রেখেছে। এ যুক্তির সঙ্গে একমত নন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি একজনের ভোট আর একজন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ যন্ত্রটিতে ভোটার আইডি প্রবেশ না করালে কোনো লাভ হবে না।
আগামী নির্বাচনে ভোট কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে যখন চারদিকে জল্পনা কল্পনা তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়ে দিয়েছেন, ভোটের পদ্ধতি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বাইরে থেকে পরামর্শ যাই আসুক সিদ্ধান্ত নেব আমরা। তবে বর্তমান পেক্ষাপটে ৩০০ সংসদীয় আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের সামর্থ্য নির্বাচন কমিশনের নেই সেকথাও জানিয়ে দিয়েছেন সিইসি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপ করেছেন। সেই সংলাপে ইভিএম এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক যুক্তি এসেছে। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন বলেছিলেন, ‘ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এটার সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। জোরের সঙ্গে বলব- ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য।’
সেন্টার ফর পলিসি ডাইলগের (সিপিডির) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘ইভিএমের ব্যবহার অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এটা থেকে দূরে থাকা ভালো। ইভিএম নিয়ে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিতে পারে। ইভিএম ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করা উচিত নয়।’
ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ যন্ত্রে যে ম্যানুপুলেট করা যায় না-তা নিশ্চিত না করে ব্যবহার করা যাবে না।’
চারদিকে ইভিএম নিয়ে যখন এত আলোচনা তখন বাস্তবায়নকারীরা কী বলেন এবিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘ইভিএমে ভোট কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। বাইরে কে কী বলল সেটা তো আমি বলতে পারব না।‘
ব্যালট পেপারের চেয়ে ইভিএমে ভোটগ্রহণ আরও নিরাপদ ও স্বচ্ছ পদ্ধতি জানিয়েছেন সদ্য সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাহাদত হোসেন চৌধুরী। তিনি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমাদের দেশে একসময় জাল ভোট হতো। কোনো কেন্দ্রে ঝটিকা একটা আঘাত হেনে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টার জন্য কেন্দ্রটা দখল করে ২০০-৩০০ ব্যালট পেপার ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটত। ইভিএম একটি যন্ত্র। এ যে অনিয়মগুলো সেগুলো চিহ্নিত করতে ভালো একটা যন্ত্র হচ্ছে ইভিএম। কেউ যদি বলে ডিজিটাল কারচুপি করা সম্ভব, এটা সম্ভব না। যদি না মেশিনের প্রোগ্রামিং চেঞ্জ করতে পারে। সেটা নিশ্চই সম্ভব না।’
‘নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনকে বাইরের লোকের উপর শতভাগ নির্ভর করতে হয়। পোলিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার হায়ার করতে হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে, তাদের উপরই ভোটের স্বচ্ছতা নির্ভর করে। যদি কেন্দ্র দখল হয়ে যায়, সেখানে যদি বুথের মধ্যে কেউ থাকে সেটা তো বুথ দখল হয়ে যাওয়া। সেখানে ইভিএমের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ব্যালট পেপারে সেটা আরও বেশি হতো। ইভিএমে অত ফাস্ট ভোট দিতে পারে না। ভোটারের উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। সব দিক বিবেচনায় ইভিএম স্বচ্ছতা বা ভালো ভোটের জন্য ব্যালট পেপারের চেয়ে বেটার।’