ঢাকায় ১১৭ টি দুর্ঘটনায় নিহত ১৪১
মার্চে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫৮৯ জন
গত মার্চ মাসে দেশে ৪৫৮ টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৮৯ জন এবং আহত ৬৪৭ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৬১ জন, শিশু ৯৬। ১৭৬ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২২১ জন, যা মোট নিহতের ৩৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৬২ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৭ দশোমিক ৫০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৩ জন, অর্থাৎ ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
সোমবার (৪ এপ্রিল) দুপুরে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন'র নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান এসব তথ্য জানিয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, এই সময়ে ৫টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত। ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত এবং ৮ জন আহত হয়েছে।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২২১ জন (৩৭.৫২%), বাস যাত্রী ৩৯ জন (৬.৬২%), ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি আরোহী ৩৪ জন (৫.৭৭%), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার যাত্রী ১৭ জন (২.৮৮%), থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-টেম্পু-জীপ-পাওয়ারটিলার) আরোহী ৮১ জন (১৩.৭৫%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের (নসিমন-চান্দেরগাড়ি-মাহিন্দ্র-টমটম) যাত্রী ২৪ জন (৪.০৭%) এবং প্যাডেল (রিকশা-ভ্যান-বাইসাইকেল) আরোহী ১১ জন (১.৮৬%) নিহত হয়েছে।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৬৭টি (৩৬.৪৬%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৭৯টি (৩৯.০৮%) আঞ্চলিক সড়কে, ৬৮টি (১৪.৮৪%) গ্রামীণ সড়কে, ৩৯টি (৮.৫১%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৫টি (১.০৯%) সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন
দুর্ঘটনাসমূহের ৭১টি (১৫.৫০%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬৮টি (৩৬.৬৮%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৫৯টি (৩৪.৭১%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৪৬টি (১০.০৪%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৪টি (৩.০৫%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রামট্রাক-মিকচার মেশিনগাড়ি ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার ৩ দশোমিক ৩৬ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১৩ দশমিক ৭১ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২২ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-লেগুনা-হিউম্যানহলার-জীপ-পাওয়ারটিলার) ১৬ দশমিক ১২ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন- (নসিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-চান্দেরগাড়ি-ম্যাজিকগাড়ি-মাহিন্দ্র-টমটম) ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং অন্যান্য ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৮৩১ টি। (ট্রাক ১৭৭, বাস ১১৪, কাভার্ডভ্যান ২৩, পিকআপ ৩৯, ট্রলি ১৫, লরি ৭, ট্রাক্টর ১২, মিকচার মেশিন গাড়ি ২, ড্রামট্রাক ৮, মাইক্রোবাস ১১, প্রাইভেটকার ১৭, মোটরসাইকেল ১৮৩, থ্রি-হুইলার ১৩৪ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-লেগুনা-হিউম্যানহলার-জীপ-পাওয়ারটিলার), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৬৬ (নসিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-চান্দেরগাড়ি-ম্যাজিকগাড়ি-মাহিন্দ্র-টমটম) এবং অন্যান্য ২৩টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, সকালে ৩৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, দুপুরে ১৯ শতাংশ, বিকালে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং রাতে ১৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, প্রাণহানি ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ; রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, প্রাণহানি ১১ দশমিক ২০ শতাংশ; চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি ২১ দশমিক ৭৩ শতাংশ; খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, প্রাণহানি ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ; বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ; সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ, প্রাণহানি ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ; রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঢাকায়
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে, ১১৭ টি দুর্ঘটনায় ১৪১ জন নিহত। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ২৬ টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে, ৩৩ টি দুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত। সবচেয়ে কম নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ২ টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ১৯ টি দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬ জন।
নিহতদের পেশাগত পরিচয়
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৩ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১১ জন, চিকিৎসক ৪ জন, স্বাস্থ্যকর্মী ৩ জন, সাংবাদিক ৪ জন, প্রকৌশলী ৩ জন, বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ৬ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৩ জন, ডিসিসি’র পরিচ্ছন্নতাকর্মী ১ জন, কারারক্ষী ১ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৪ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৩৬ জন, পোশাক শ্রমিক ৯ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৪ জন, ইটভাটা ও বালু শ্রমিক ৫ জন, রং মিস্ত্রি ২ জন, রাজমিস্ত্রি ৩ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ২ জন, ইউপি চেয়ারম্যান ২ জন, ইউপি সদস্য ৩ জন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৪ জন এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসাবে যা বলছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন;
২. বেপরোয়া গতি;
৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা;
৪. বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা;
৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল;
৬. তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো;
৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা;
৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা;
৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি;
১০ গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
পরিস্থিতির উত্তরণে সুপারিশসমূহ
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে;
২. চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে;
৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে;
৪. পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;
৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে;
৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে;
৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে;
৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে;
৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে;
১০.“সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন'র দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য
সড়ক দুর্ঘটনায় গত মার্চ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৯ জন নিহত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৬ দশমিক ৭৫ জন। এই হিসাবে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চ মাসে প্রাণহানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৪৬৩ জন, অর্থাৎ ৭৮ দশমিক ৬০ শতাংশ।
ট্রাক-সহ পণ্যবাহী দ্রুতগতির যানবাহন ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে পণ্যবাহী যানবাহন চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। পথচারী নিহতের ঘটনাও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলে না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।
এই আতঙ্কজনক প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
কেএম/এএস