খুলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, অপেক্ষা আর ৯৭ দিন
৩০ জুনকে ডেট লাইন ধরলে অপেক্ষা আর মাত্র ৯৭ দিন। তারপরই বাংলাদেশের স্বপ্ন ডানা মেলবে পদ্মার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সম্ভাব্য দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। ৩০ জুনের মধ্যে যেকোনো দিন উদ্বোধন হবে বাংলাদেশের স্বপ্ন। তবে ধারণা করা হচ্ছে সেই দিনটি ২৩ জুন হতে পারে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৫০ বছরের আক্ষেপ আর অপেক্ষার পালা শেষ হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী কুরবানি ঈদে গাড়ি নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় যেতে পারবেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না ফেরীর জন্য। পদ্মা পাড়ি দিয়ে মাত্র ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পৌঁছা যাবে কোনোরকম ট্রাফিক ছাড়াই।
সেতু বিভাগের সচিব মো, মনজুর হোসেন বুধবার (২৩ মার্চ) বিকালে ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। গত মঙ্গলবারও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ৩০ জুনের মধ্যেই কাজ শেষ করতে। সে লক্ষ্যেই কাজ চলছে।
আগামী ৩০ জুনের মধ্যেই পদ্মা সেতুর সকল কাজ শেষ করতে চায় সেতু কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে মোট ৯৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাকি সাড়ে তিন শতাংশ শেষ করতে দ্রুত গতিতে কাজ চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। সেতুর কাজে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেতুর সড়ক অংশ খুলে দেওয়ার জন্য ৩০ জুনের মধ্যেই তারা বাকি কাজ শেষ করে ফেলবেন।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এখন মূল সেতুর উপরি অংশে চলছে দুই লেয়ার বা স্তরের পিচ ঢালাইয়ের কাজ। একই সঙ্গে ভায়াডাক্ট কার্পেটিং-এর কাজও চলছে দ্রুত গতিতে। ইতিমধ্যে ৬০ শতাংশ পিচ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজও দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
এ ছাড়া সেতুর ল্যাম্পপোস্ট লাগানোর কাজ শেষ হয়েছে ২০ শতাংশ। চলছে অ্যালুমিনিয়াম রেলিং নির্মাণ, সিগন্যাল সিস্টেম ও অন্যান্য কাজও চলছে সমানতালে। এসব কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে।
এর বাইরে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের কাজ ৯৯ শতাংশ এবং ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইন টানার কাজ শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশ।
সূত্র জানায়, সেতুর দুই প্রান্ত অর্থাৎ মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ওয়াই গার্ডারের মধ্যবর্তী স্থানে শাপলা মন্যুমেন্ট নির্মাণের কাজও চলছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পদ্মায় সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানি সাহায্য সহায়ক সংস্থা (জাইকা) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করে। ওই সময়ই ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ওপর সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন; যার মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের বীজ বপন করা হয়।
মাঝখানের আট বছর খুব একটা অগ্রগতি না হলেও ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাশের স্বপ্ন পদ্মা সেতুর নকশা চূড়ান্তকরণের কাজ সম্পন্ন হয়। এরমধ্যেই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়। কিন্তু ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক হঠাৎ করেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এবং বিশ্বব্যাংক নিজেরাই তদন্ত শুরু করে। ২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক সরকারের সঙ্গে করা ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে।
কথিত দুর্নীতির অভিযোগ উঠা এবং তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের পদত্যাগসহ নানান ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ করার ঘোষণা দেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব্যাংককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত বিশ্ব্যাংক দুর্নীতির কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি।
২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নিজস্ব অর্থায়নে পুরোদমে শুরু হয় সেতু নির্মাণের কাজ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় যোগাযোগ অবকাঠামো হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে ৪১টি পিয়ারের উপর। তার উপর বসানো হয়েছে ৪২টি স্প্যান। দ্বিতল সেতুর উপরে চার লেনের সড়ক। নিচে রয়েছে রেলপথ। সেতুর ওপরে সড়কভাগে স্ল্যাব বসেছে মোট ২ হাজার ৯১৭টি। আর নিচে সেতুর রেলপথে বসেছে মোট ২ হাজার ৯৫৯টি স্ল্যাব।
পদ্মা সেতু দিয়েই দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্যাস সংযোগ। টানা হচ্ছে বিদ্যুৎ লাইন।
২০২১ সালের জুন মাসেই সরকার পদ্মা সেতু খুলে দিতে চেয়েছিল। সেই লক্ষ্যেই কাজ চলছিল। কিন্তু ২০২০ সালে শুরু হওয়া অতিমারী করোনার কারণে সেতুর নির্মাণ কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হয়। তবে কাজ থেমে থাকেনি। যার ফলে সেতু খুলে দেওয়ার সময়সীমা পিছিয়ে যায়। তবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বার বার বলছিলেন, ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই সেতুর সড়ক অংশ খুলে দেওয়া হবে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এক হবে পদ্মার এপাড়-ওপাড়। পদ্মার বুক চিরে যার এক প্রান্ত ছুঁয়ে থাকবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, অন্য প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা। দূরত্ব কমে আসবে দেশের এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের। গতি বাড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতির, চাকা ঘুরবে দ্রুতবেগে। এক শতাংশের বেশি হারে জিডিপি বাড়বে। ভাগ্য বদলে যাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলার মানুষের। বাড়বে জীবনযাত্রার মানও।
টিটি/