বিশেষ লেখা
প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা এবং আমাদের অঙ্গীকার
গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অপর তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে, আইনসভা, বিচার বিভাগ, ও আমলাতন্ত্র। বোঝাই যাচ্ছে গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও অবস্থান কোথায়! স্বাধীন ও সার্বভৌম গণমাধ্যম ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পূর্ণতা পায় না। সরকার ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ সরকার কোনো ফেরেস্তা দিয়ে পরিচালিত হয় না। সরকারের সেই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই গণমাধ্যমকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হয়।
আসলে গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের পাহারাদার। রাষ্ট্রে অন্যায় অনিয়ম হলে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি হলে তা ধরিয়ে দেয় গণমাধ্যম। সরকার ভুল পথে পরিচালিত হলে, ভুল কাজ করলে গণমাধ্যমই সঠিক পথ বাতলে দেয় যাতে সরকার সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। গণমাধ্যম কখনও সরকারের প্রতিপক্ষ নয়; বরং সহযোগী। কাজেই বলিষ্ট ও শক্তিশালী গণমাধ্যম ছাড়া রাষ্ট্রব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না। গণতন্ত্র স্থায়ী হয় না।
রাষ্ট্রের অন্য তিনটি স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে গেলেও চতুর্থ স্তম্ভ শক্ত থাকলে রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আর চতুর্থ স্তম্ভ নড়বড়ে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে, রাষ্ট্র বিপদগ্রস্ত হয়। রাষ্ট্রের ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আশাবাদী মানুষ। তারপরও আমি সামনে ঘোর অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। আঁধার কেটে নিশ্চয়ই আলো আসবে। কিন্তু সেটা কি প্রকৃতির নিয়মে হবে? নাকি কাউকে না কাউকে ভূমিকা পালন করতে হবে? গণমাধ্যমের পরতে-পরতে ঢুকে পড়া হলুদ সাংবাদিকদের বিতাড়ন করবে কে? কে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভকে বুকে আগলে রাখবে!
এখন সাংবাদিকতায় ভয়ঙ্কর সংকটকাল চলছে। এই সংকটের শুরু বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। ধীরে-ধীরে তা গভীর খাদের কিনারে এসে ঠেকেছে। এখনও সজাগ না হলে সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা হারিয়ে যাবেন। সাংবাদিকতার ডিকশনারি থেকে সততা ও পেশাদারিত্ব শব্দ দুটি বিলীন হয়ে যাবে। সেখানে জায়গা করে নেবে অসততা, হলুদ সাংবাদিকতা।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, হলুদ সাংবাদিকতার ভয়ে মানুষ তটস্থ। এক সময় মানুষ পুলিশকে খুব ভয় পেত। পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তীক্ত অভিজ্ঞতার কারণে বলা হতো, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা; আর পুলিশ ছুঁলে ৩৬ ঘা।
হলুদ সাংবাদিকদের কারণে এখন প্রবাদটির নতুন সংস্করণ হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে ৩৬ ঘা; আর সাংবাদিক (হলুদ সাংবাদিক) ছুঁলে ৭২ ঘা। কেউ বিশ্বাস করুন বা না করুন পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়িয়েছে। পুলিশও এখন সাংবাদিকদের ভয় পায়।
হ্যাঁ, এই ভয়টি আগেও ছিল। দুর্নীতিবাজ পুলিশের ঘুষের কাহিনি ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা সাংবাদিকদের ভয় পেত। এখন দুর্নীতিবাজ পুলিশ আর হলুদ সাংবাদিক একাকার হয়ে গেছে। যেন হরিহর আত্মা। সঙ্গত কারণেই হলুদ সাংবাদিকদের দাপট অনেক বেশি। তাদের হুংকারে পেশাদার ও সৎ সাংবাদিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। অনেকে মান-ইজ্জত হারানোর ভয়ে পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন।
আমি নিশ্চিত, এ রকম বৈরি পরিস্থিতিতে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছেন না সৎ সাংবাদিকরা। পেশায় আসার আগে আপনারা হয়তো ভাবতেন এক রকম; কাজ করতে এসে দেখছেন আরেক রকম। সাংবাদিকতার নামে হলুদ সাংবাদিকতা দেখে অনেকে হতাশায় চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। অনেকে ধৈর্য ধরে কোনোমতে টিকে আছেন। যারা টিকে আছেন তাদের অভিবাদন জানাই। তারা সত্যি সত্যিই এই পেশাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন।
আমার মনে হয়, সৎ সাংবাদিকদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলুদ সাংবাদিকতা। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দলকানা সাংবাদিক। গত এক দশকে এ দুটি সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। যারা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে ব্রত হিসেবে নিতে চান তারাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। অনেকে বলছেন, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? সবাইকে দিয়ে এই কাজ হবে না। তবে কাউকে না কাউকে তো আওয়াজ তুলতে হবে। আমরা সেই আওয়াজ তুলতে চাই।
তবে এজন্য প্রয়োজন একদল সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিক। এ কথা এ কারণে বলছি যে, সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব ছাড়া সুসাংবাদিকতা হবে না। আগে মনেপ্রাণে এই তিনটি বিষয় ধারণ করতে হবে। সেটি না করতে পারলে এই পেশায় হলুদ সাংবাদিকতা আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করবে। এক সময় সুসাংবাদিকতা শব্দটিই হারিয়ে যাবে। আমরা অনেক সময় ছোট পত্রিকা এবং সেখানে যারা কাজ করেন তাদের অন্য দৃষ্টিতে দেখি। কিন্তু বড় গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন তারা কতটা সুসাংবাদিকতা করছেন সেটি কি একবারও পরখ করে দেখেছি?
সাংবাদিকতা পেশার সামগ্রিক স্বার্থেই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। যারা এই পেশায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তারা টের পান, সাংবাদিকতার নামে কে কী করছেন? কে কত টাকা কিভাবে কামিয়েছেন কিংবা কামাচ্ছেন। জেলা পর্যায়ে অধিকাংশ সাংবাদিকের নামে বদনাম আছে। তারা পেশাকে কলঙ্কিত করছেন বলে সাধারণ মানুষও আজকাল অভিযোগ করে থাকেন। এসব অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সুসাংবাদিকতার কোনো বিকল্প নেই।
আগে আমাদের গুরুস্থানীয় সম্পাদকরা বলতেন, ’জানবে বেশি লিখবে কম।’ এখন সেই ধারনা উল্টে গেছে। এখন দেখা যায়, জানে কম লেখে বেশি। মানে কোনো ঘটনা সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই রিপোর্ট করে দেয়। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলেই লিখে দিতে হবে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। একজন রিপোর্টারের কলমের খোঁচায় অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। আবার অনেক বড় উপকারও হতে পারে। মানুষের উপকারের বিষয়টিই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল সাধনই তো সাংবাদিকদের কাজ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর সেই বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আমরা নতুন ভাবনা, নতুন পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করছি। আমাদের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ। হৃদয়ে আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এই দেশ স্বাধীন না করলে আমরা কেউ মন্ত্রী হতে পারতাম না। সচিব হতে পারতাম না। সম্পাদক হতে পারতাম না। বড় কোনো পদে চাকরি করতে পারতাম না। সেই ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের মতো আমাদের চাকর-বাকরই থাকতে হতো।
আমরা বিশ্বাস করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা বুকে ধারণ করে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। দেশের উন্নয়নের অভিযাত্রায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চাই। আমরা অবহেলিত, বঞ্চিত আর নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকতে চাই। আমরা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে চাই। আমরা কোনো অন্যায়ের কাছে কিংবা কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করতে চাই না।
আমাদের স্লোগান হচ্ছে, সততাই শক্তি, সুসাংবাদিকতায় মুক্তি। এটিই আমাদের বিশ্বাস, আমাদের আদর্শ। এর বাইরে আমাদের অন্য কোনো নীতি-আদর্শ নেই। আমাদের এই আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে যারা সহযাত্রী হতে চেয়েছেন তাদের নিয়েই আমি আমার টিম গঠন করেছি।
আমরা জানি, চলার পথে অনেক বাধা আসবে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা ভাঙবো কিন্তু মচকাব না। আমরা হোঁচট খাব কিন্তু আমরা থেমে যাব না। আমাদের এই অভিযাত্রায় দেশপ্রেমিক মানুষের সহযোগিতা চাই।
আমার বিশ্বাস, এই দেশকে যারা ভালোবাসেন, এই দেশের যারা মঙ্গল চান, তারা নিশ্চয় আমাদের পাশে থাকবেন। আমাদের ভুল ধরিয়ে দেবেন। আমাদের অনুপ্রেরণা দেবেন। পেছনে থেকে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাবেন। এ দেশের সহজ-সরল সাধারণ মানুষের পাশে থেকে দেশের স্বার্থে কাজ করতে চাই।
পরিশেষে আমার প্রিয়তম কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার মতো করে বলতে চাই:
অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির।
ভয়ে কাঁপে কা-পুরুষ লড়ে যায় বীর।
লেখক: প্রধান সম্পাদক ঢাকাপ্রকাশ ও সাহিত্যিক।
mostofakamalbd@yahoo.com