ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১১
দ্য ফার্স্ট ম্যান
লিসিতে তার ক্লাসমেটদের বাসায় এবং পরবর্তীতে আরো সব বাড়িতে আসবাবপত্র দেখার পরে নিজের বাড়ির ওই চেহারাটা আরো স্পষ্ট করে মনে এসেছে। জ্যাক দেখেছে, ফুলদানির মতো পাত্র, বাটি, ছোট আকারের মূর্তি আর পেইন্টিংয়ে ঠাসা ওইসব বাড়ির রুমগুলো। তাদের বাড়িতে পরিবারের লোকদের ভাষ্যে তাকের ওপরের ফুলদানি, পাত্র, সুপের বাসন, কিংবা আরো কোনো জিনিস থাকলে সেগুলোর কোনো নিজস্ব নাম ছিল না।
অন্যদিকে তার বড় মামার বাড়িতে ভোসগেস থেকে আনা চকচকে মাটির পাত্রের প্রশংসা না করে কেউ পারত না। সেই পাত্রে যে কেউই কুইম্পার ডিনারও খেয়ে ফেলতে পারত। মৃত্যুর মতো নাঙ্গা দারিদ্রের মধ্যে জ্যাক বড় হয়েছে; সেখানে সব কিছুরই সাধারণ নাম। আর মামার বাড়িতে গিয়েই কেবল সে ওইসব জিনিসের নিজস্ব নাম খুঁজে পেয়েছে। এমনকি এখনও নতুন করে ধোয়া এই টালির ঘরে সাধারণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আসবাবপত্রের সঙ্গে তেমন কিছুই নেই, শুধু খোদাই করা তামার তৈরি একটা আরবীয় ছাইদানি দেখা যাচ্ছে। সেটাও সম্ভবত তার আগমন উপলক্ষে। আর দেয়ালে ঝুলছে একটা পোস্ট অফিসের ক্যালেন্ডার। এখানে দেখার মতো কিংবা বলার মতো আর কিছুই নেই। কাজেই মা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতায় যা দেখেছে তার বাইরের আর কিছুই জানার নেই; এমনকি তার বাবা সম্পর্কেও।
–বাবা?
–হ্যাঁ, মা তার দিকে এবার মনোযোগ দিয়ে তাকালেন।
–বাবার নাম ছিল হেনরি, আর কিছু?
–আমি জানি না।
–বাবার কি আর কোনো নাম ছিল না?
–মনে হয় ছিল, আমার মনে পড়ছে না। মা হঠাৎ মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তার দিকে তাকালেন। সূর্য এখন সর্বশক্তি নিয়ে রাস্তায় তেজ ছড়াচ্ছে।
–বাবা আমার মতোই দেখতে ছিলেন?
–হ্যাঁ, অবিকল তোর মতো। তার চোখ ছিল নীল। তার কপালটাও একদম তোর মতো।
–বাবার জন্ম হয়েছিল কত সালে?
–জানি না। তোর বাবার চেয়ে আমি চার বছরের বড় ছিলাম।
–তোমার জন্ম কত সালে?
–তাও জানি না। আমাদের পরিবারের একটা রেকর্ড খাতা আছে। ওখানে দেখতে পারিস।
শোয়ার ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে জ্যাক দেখতে পেলো, ওপরের তাকে রয়েছে কয়েকটা তোয়ালে, একটা পারিবারিক রেকর্ড খাতা, পেনশনের একটা খাতা আর স্প্যানিস ভাষায় লেখা পুরনো কিছু দলিলপত্র। কাগজপত্রগুলো নিয়ে ফিরে এল জ্যাক।
–বাবার জ্ন্ম ১৮৮৫ সালে। আর তোমার ১৮৮২ সালে। বাবার চেয়ে তুমি তিন বছরের বড়।
–ও, আচ্ছা; আমি ভেবেছিলাম চার বছরের; কতদিন আগের কথা।
–তুমি বলেছিলে, বাবা তার মা বাবাকে হারিয়েছিলেন খুব ছোট থাকতে। তার ভাইয়েরা তাকে এতিমখানায় পাঠিয়েছিল।
–হ্যাঁ, তার বোনকেও।
–তার বাবা মায়ের একটা খামার ছিল?
–হ্যাঁ, তারা ছিল আলসেসীয়।
–উলেদ-ফায়েতে?
–হ্যাঁ, আর আমরা ছিলাম চিরাগাছে, খুব কাছেই।
–বাবা যখন তার মা বাবাকে হারান তখন তার বয়স কত ছিল?
–জানি না। তবে খুব অল্প বয়সে। তার বোনও তাকে ছেড়ে চলে যায়। কাজটা ঠিক হয়নি। ভাইবোনদের কারো সঙ্গে সে আর দেখা করতে চায়নি।
–তার বোনের বয়স কত ছিল?
–ঠিক জানি না।
–তার ভাইদের বয়স কত ছিল? বাবা কি সবার ছোট ছিল?
–না, দ্বিতীয় ছিল।
–তাহলে তো তার ভাইয়েরাও তাকে দেখাশোনা করার মতো বয়সী ছিল না।
–হ্যাঁ, সেরকমই।
–তাহলে তো তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
–যায় না। তবে সে তাদেরকে দোষীই মনে করত। এতিমখানা থেকে বের হয়েছিল সে ষোল বছর বয়সে। এরপর তার বোনের খামারে কাজ করতে যায়। সেখানে ওকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। খুব কষ্ট হতো তার।
–তারপর বাবা চিরাগাছে চলে আসেন?
–হ্যাঁ, আমাদের ওখানে।
–ওখানেই বাবার সাথে তোমার দেখা হয়?
–হ্যাঁ, বলে মা রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। জ্যাকের মনে হয়, ওই দিকে আলাপ চালিয়ে যাওয়া কঠিন। তবে মা নিজেই আরেক দিকে শুরু করলেন, তোকে বুঝতে হবে, এতিমখানায় তোর বাবা লেখাপড়া শিখতে পারেনি।
–তবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তোমাকে পাঠানো বাবার পোস্টকার্ড দেখিয়েছিলে।
–হ্যাঁ, সে এম ক্লাসোঁর কাছ থেকে লিখতে শিখেছিল।
–রিকমের কাছে থাকতে?
–হ্যাঁ, এম ক্লাসোঁ ছিলেন ওদের বস। তিনিই ওকে লিখতে পড়তে শিখিয়েছিলেন।
–তখন বাবার বয়স কত ছিল?
–ঠিক জানি না। তবে বছর বিশেক ছিল হয়তো। সে অনেক দিন আগের কথা। তবে যখন আমাদের বিয়ে হলো ততদিনে সে মদ সম্পর্কে জেনেছে। যে কোনো জায়গাতেই কাজ করার ক্ষমতা ছিল। তোর মতোই কর্মক্ষমতা আর বাস্তব বুদ্ধি ছিল তোর বাবার। মা জ্যাকের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন।
–তারপর?
–তারপর? তারপর তোর ভাইয়ের জন্ম হলো। তখন তোর বাবা রিকমের জন্য কাজ করত। রিকম তাকে পাঠিয়ে দিলেন সেন্ট লাপুত্রেয়, তার খামারে।
–সেন্ট লাপুত্রেয়?
–হ্যাঁ, তারপরই তো যুদ্ধ শুরু হলো। সে মারা গেল। ওরা আমাকে গোলার টুকরো পাঠিয়েছিল।
তার বাবার মাথায় আঘাত করেছিল যে গোলার টুকরো সেটা আলমারিতে তোয়ালের নিচে ছোট একটা বিস্কুটের কৌটোয় রাখা আছে; সঙ্গে আছে একটা শুকনো কার্ড, তাতে বাবা রণাঙ্গন থেকে যা লিখেছিলেন জ্যাকের মনে আছে: প্রিয়তমা লুসি, আমি ভালো আছি। আগামীকাল আমাদের আবাস বদল হবে। বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রেখো। আমার চুমু নিও। –তোমার স্বামী।
–হ্যাঁ, তার জন্মের রাতের গভীরে সে নিজেও একজন অভিবাসী, অভিবাসী বাবা মায়ের সন্তান। বাবা মায়ের অবস্থান পরিবর্তনের সময় তার জন্ম। ইউরোপ তখন কামানের শব্দ ভাঁজছে; সেই কামান একযোগে কিছুদিন পরই সেন্ট লাপুত্রে থেকে করমারি পরিবারের স্বামীকে আলজিয়ার্সে তার সামরিক বাহিনীতে আর স্ত্রীকে তার মায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। মায়ের কোলের কান্নারত শিশুটির শরীর সেবুসের মশার কামড়ে ফোলা। জ্যাকের মা জ্যাকের নানিকে বলেছিলেন, চিন্তা করো না, মা। হেনরি ফিরে আসলেই আমরা চলে যাব।
আর ঋজু শরীরের নানি সাদা চুল পেছনের দিকে নিতে নিতে তীক্ষ্ণ চোখের কড়া চাহনিতে বলেছিলেন, শোনো মেয়ে, এখানে থাকতে হলে তোমাকে কাজ করে খেতে হবে।
–বাবা তো যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন।
–হ্যাঁ, মরক্কোর যুদ্ধক্ষেত্রে।
–সত্যি। জ্যাক ভুলে গিয়েছিল। ১৯০৫ সালে তার বাবার বয়স ছিল বিশ বছর। তিনি তখন মরক্কোবাসীদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ ছিলেন। জ্যাকের মনে পড়ে গেল, কয়েক বছর আগে তার স্কুলের শিক্ষক এম লেভেস্ক আলজিয়ার্সের রাস্তায় হঠাৎ দেখা হওয়ার সময় যা বলেছিলেন। তার বাবার সময়েই এম লেভেস্ককেও দায়িত্ব পালনের জন্য ডাকা হয়েছিল। তবে তারা একই ইউনিটে মাত্র এক মাস ছিলেন। এম লেভেস্ক যা বলেছিলেন সে অনুযায়ী করমারির সঙ্গে তার খুব বেশি জানাশোনা ছিল না। করমারি খুব বেশি কথাবার্তা বলতেন না। ক্লান্তির কারণে হতে পারে, অথবা তিনি ছিলেন মুখচাপা মানুষ। তবে সাদাসিধা এবং খোলা মনের ছিলেন।
একবার তিনি করমারিকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। খুব গরমের একটা দিনের শেষে রাতের বেলা দেখা হয়েছিল অ্যাটলাস পর্বতের পাশে বাইরে। সেখানে তাদের ইউনিট একটা পাথুরে গিরিপথ ঘেরা এক পাহাড়ের ওপরে ক্যাম্প তৈরি করেছিল। গিরিপথের পাদদেশে দায়িত্বরত একজন পাহারাদারকে বদলি দেওয়ার কথা ছিল করমারি আর এম লেভেস্কের। তারা পাহারাদারকে ডাকলেন। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেলেন না। শেষে একটা ফণিমনসা ঝোপের গোড়ায় তাদের সঙ্গীর দেখা পেলেন; তার মাথাটা পেছনের দিকে ফেরানো। অদ্ভূতভঙ্গিতে ওপরের আকাশে চাঁদের দিকে যেন তাকিয়ে আছেন।
প্রথমত তারা তার মাথাটাকে ভালো করে বুঝতে পারেননি–কেমন অদ্ভূত দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু চিত্রটা ছিল খুবই সাধারণ। তার গলা কাটা হয়েছিল এবং তার মুখের ভেতর ভয়ঙ্কর স্ফিতিটা ছিল আসলে তারই গোটা শিশ্ন। সে চিত্রটাও তারা ভালো করে দেখতে পেয়েছিলেন লোকটার পরনের পোশাক দেখে: তার সুয়াভ পাতলুনটা ফালা ফালা করে ছিড়ে ফেলা হয়েছিল। পা দুটো দুদিকে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল। আর চাঁদের মৃদু আলোয় তারা দেখলেন, তার দুপায়ের মাঝখানে প্যাচপেচে কাদার মতো কী যেন। ওই একই সময়ে একশো মিটার সামনের দিকে দ্বিতীয় পাহারাদারকেও পাথুরে ঝোপের আড়ালে একই ভঙ্গিতে ফেলে রাখা হয়েছিল। তারপর সতর্ক সংকেত বাজানো হয় এবং পাহারা দ্বিগুণ করা হয়।
ভোরবেলা ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার পর করমারি বলেছিলেন তাদের শত্রুরা পুরুষ নয়। ঘটনাটা নিয়ে চিন্তা করে লেভেস্ক বলেছিলেন, ওরা যেরকম আচরণ করেছে যেকোনো মানুষই নিজেদের দেশে শত্রুদের সঙ্গে ওইরকম আচরণই করবে: তারা সর্বশক্তি দিয়ে সব রকম কৌশল অবলম্বন করে তাদের মোকাবেলা করতে চেষ্টা করেছে।
তখন করমারির মুখটা দেখতে মরা মানুষের মুখের মতো। তিনি বলেছিলেন, হতে পারে। তবে তাদের এই আচরণ মানুষসুলভ নয়। কোনো মানুষের পক্ষে ওরকম আচরণ করা মানায় না।
লেভেস্ক বলেছিলেন, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ সবকিছুই করতে পারে, সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে।
তখন করমারি যেন রাগে উন্মত্ত হয়ে বলেছিলেন, যেকোনো মানুষের পক্ষেই এরকম কাজ করা অবমাননাকর। এরকম কাজ মানুষকে..., বলে থেমে গিয়েছিলেন। তারপর শান্ত স্বরে বলেছিলেন, আমার কথা যদি বলি, আমি গরিব; আমি এতিমখানা থেকে এসেছি। ওরা আমাকে এই ইউনিফর্ম পরিয়েছে। ওরা আমাকে যুদ্ধে টেনে এনেছে। কিন্তু আমি নিজেকে ওই রকম কাজে জড়াতে দিতেই পারি না।
লেভেস্ক বলেছিলেন, অনেক ফরাসিই ওরকম কাজ করে থাকে।
–তারা তাহলে মানুষের জাতই নয়। হঠাৎ চিৎকার বলে করমারি বলেছিলেন, নষ্ট জাতি একটা! কী খারাপের খারাপ জাতি! ওরা সবাই! সবাই। শেষে হতাশায় বিবর্ণ হয়ে তিনি তাবুর দিকে চলে গিয়েছিলেন।
(চলবে)
এসএ/