ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৭
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
বীথিকা এখন কলেজের ছাত্রী। নিজের গ্রামের সৌন্দর্য দুচোখ ভরে উপভোগ করে। শৈশব থেকে গ্রামের পথঘাটে অনেক ঘুরেছে। এখন খুলনার সরকারি কলেজে পড়ে। ছুটিতে বাড়িতে এলে প্রাণভরে তাকিয়ে থাকে গ্রামের চারদিকে। দাকোপ মহকুমার শ্রীনগর গ্রামে তাদের বাড়ি। বাবা হরেন্দ্রনাথ মা মায়ারাণী আর তিন ভাই কৃষ্ণপদ, নিরঞ্জন, অমল সবার সঙ্গে বেশ দিন কাটে বীথিকার। সুন্দরবনের খুব কাছে বলে গ্রামটি ওর ভীষণ প্রিয়। গ্রামটির চারদিকে নদী আছে। দূর থেকে সুন্দরবনের দিকে তাকিয়ে থাকলে মা বলে, তুই কি ভবিষ্যতে গিয়ে থাকবি ওখানে?
-বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারলে গিয়ে থাকব। গাছপালা নিয়ে ঘুমাব। বাঘ আমাকে পাহারা দেবে। পাখিদের কূজন শুনব ভোরের আলো ফোটার আগে।
-ভালোইতো, কত সুন্দর করে বললি যে আমার মন ভরে গেল।
-মাগো, আমরা একদিন নৌকায় করে সুন্দরবনের ধারে বেড়াতে যাব।
-এখন আর হবে না রে।
-কেন মা?
-রেডিওতে শুনলিনা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করেছে।
-এখন যুদ্ধ শুরু হবে মা। আমার তিনটি ভাই এতই ছোট যে যুদ্ধ করতে পারবেনা।
হরেন্দ্রনাথ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে, মাগো এত ভাবিসনা।
-আমাদের এলাকায় পাকবাহিনী আসতে পারবেনা বাবা?
-কেন রে মা?
-এই যে চারদিকে নদী। ওদের বড় বড় গাড়ি কীভাবে আসবে?
-ওরা কি আর পথে আসবে? আমাদের এদিকে আসতে হলে গানবোটে আসবে।
-ঠিক বলেছ বাবা। আমাদেরকে সতর্ক হয়ে থাকতে হবে।
-তুই আর বেশি গ্রামে ঘুরিসনা। বাড়িতে থাকিস।
-হ্যাঁ বাবা থাকব। মায়ের কাছে যাই।
মায়ারাণী রান্না করছে। বীথিকা পেছনে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে।
-মাগো এই যুদ্ধের সময় তোমার একটা বাচ্চা হবে। আমার তিন ভাই আছে। আমি এবার একটা বোন চাই।
মায়ারাণী মৃদু হেসে বলে, ভগবান যা দেবে আমি তাকেই বুকে আঁকড়ে ধরব। ভগবান তোর ইচ্ছা পূরণ করলে আমি খুশি হব।
বীথিকা মাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়।
-ভগবান ভাই বা বোন যা দেবেন আমি তাকেই কোলে তুলে নিয়ে আদর করব মাগো। অমি যাই এখন দেখি ছোট ভাইগুলো কোথায় কি করছে।
-ওদেরকে বেশি দূরে যেতে দিসনা। ঘরে ডেকে নিয়ে আয়।
বীথিকা বাইরে বেরিয়ে চারদিকে তাকায়। কোথাও ওদেরকে দেখা যাচ্ছেনা। ও সামনে আগায়। দেখতে পায় ভদ্রা নদীর ধারে ওর তিন ভাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে হাত নাড়ায়। কাছে যেতে ডাকে। বীথিকা ছুটে যায় ওদের কাছে।
কৃষ্ণপদ বলে, দিদি দেখ একটা কেমন নৌকা। এর আগে এই নদীতে কখনো দেখিনি।
-কই রে?
-ওই যে দূরে, এখান দিয়েই ওদিকে গেল।
বীথিকা গানবোট দেখে আঁতকে ওঠে।
-এটা আমিও আগে দেখিনি রে। বাবা বলেছে পাকবাহিনী গানবোটে করে আসবে। ওরা তাহলে আমাদের এলাকায় ঢুকতে শুরু করেছে। আয় আমরা বাড়ি যাই। আয় দৌড়াই।
বীথিকা আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়। বাবাকে খবরটা জানাতে হবে যে মিলিটারি আমাদের এলাকায় ঢুকেছে। ও ভাইদের হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল হরেন্দ্রনাথ। মেয়েকে দৌড়াতে দেখে তার বুক কেঁপে ওঠে। ওর সঙ্গেতো ছেলেরা আছে। তাহলে কোনো খারাপ খবর শুনতে হবে না। বীথিকা ওদের নিয়ে ফিরে আসছে। বাতাসে উড়ছে ওর চুল। ওর পেছনে আছে নদী আর চারপাশে সবুজ গাছ-গাছালী। হরেন্দ্রনাথের সামনে একটি অপরূপ দৃশ্য নয়ন জুড়িয়ে দেয়। নিজেকে বলে, আমার মাতৃভূমি। মাতৃভূমির স্বাধীনতা চাই। বঙ্গবন্ধু আপনাকে লাল সালাম। প্রণাম জানাই আপনাকে। আপনি পাকিস্তানের জেলে সুস্থ থাকেন। স্বাধীন দেশে ফিরে আসবেন আমাদের কাছে।
একটু পরেই ফিরে আসে বীথিকা। ছোট ছেলেরা বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তিনজনই চেঁচিয়ে বলে, বাবা, বাবা, আজকে নদীতে নতুন নৌকা দেখেছি। একদম অন্যরকম। নৌকায় যারা ছিল তাদের হাতে বন্দুক ছিল।
-থাম, বাবারা, থাম। মারে তুই কি দেখেছিস?
-না, বাবা, আমি যখন গিয়েছি গানবোট তখন অনেক সামনে চলে গেছে। আমি এর জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে এসেছি বাবা। ওরা আমাকে দেখেনি।
-ভালো করেছিস। ভগবান, আমাদের রক্ষা করবে। চল, ভেতরে যাই।
সবাই মিলে ঘরে ঢুকে। মায়ারাণী এসব খবর শুনে বলে, আমার মনে হয় ওরা শুধু একা থাকবে না। বাঙালিরাও ওদের সঙ্গে ভিড়বে।
-এসব কথা এখন বলোনা। ভুলে যেওনা যে আমরা হিন্দু। এসব কথা শুনলে আমাদের আশেপাশের মুসলমানরা আমাদের ছাড়বে না।
-অনেকেতো ভারতে চলে যাচ্ছে। আমরাও চলে যাই।
-তাহলে কি আমরা শরণার্থী হব? বীথিকা বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে।
-দুজনেই মাথা নেড়ে সায় দেয়।
মা বলে, এখানে পাকবাহিনীর ঝামেলার মধ্যে না থেকে আমরা শরণার্থী শিবিরে কষ্ট করে থাকব। ওখানেতো কেউ আমাদেরকে প্রাণে মারবেনা। আমার একটি মেয়ে তিনটি ছেলেকে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকতে চাই। ওরা যেন বাবা-মায়ে ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়।
-আমি মেয়ে। এখানে থাকলে আমার বিপদ বেশি। আমি এখানে থাকব না। কিন্তু আমাদের বাড়িঘরের কি হবে?
-চারদিক বন্ধ করে রেখে যাব।
-যদি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়?
হরেন্দ্রনাথ বলে, দিতে পারে। যদি দেয় আমাদের কিছু করার থাকবেনা। দেশ স্বাধীন হলে আমরা পোড়া ভিটায় ঘর তুলব।
-বাবা ঠিক বলেছ, তাহলে আমাদের নতুন ঘরে স্বাধীনতার থাকা হবে। নতুন মাটিতে নতুন বাড়ি।
তিনভাই লাফিয়ে ওঠে, নতুন বাড়ি, নতুন বাড়ি। আমরা নতুন বাড়িতে থাকব।
ওরা লাফাতে লাফাতে চেঁচিয়ে ওঠে, ওই যে দেখ নতুন নৌকা যাচ্ছে।
(চলবে)