ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৭
নেই দেশের নাগরিক
“শুধু কী আর এই ত্রিপলে জমে থাকা পানি, ক্ষমতা থাকলে আস্ত ‘আশ্বিনের ঝড়’টাকেই গুলি করে মেরে ফেলতাম। সর্বনেশে ঝড় কোত্থেকে এসে চালচুলোহীন অসহায় মানুষগুলোকে জানের নাজেহাল করে দিয়ে গেল! কত মানুষ যে মাটিতে মিশে গেল তার ইয়ত্তা নেই!” মুখটা ক্ষোভে হিংসায় দীর্ণ হয়ে ওঠে সাদ্দামের। রাইফেলের নলটাকে আরও একবার খোঁচা দিয়ে বলল, “বুলেটের নলই তো এখন আমাদের একমাত্র সম্বল। ক্ষমতার উৎস। পেটে ভাত থাক না থাক, হাতে রাইফেল থাকলেই হলো। ওতেই সব খিদে মারা পড়বে। এই বন্দুকের নলের মাথা দিয়েই তো আসবে আমাদের নিজস্ব দেশ। স্বাধীন ভিটে।“
“সে পথের শেষ যে কোথায় কে জানে!“ উদাস হয়ে ওঠে আতিফ।
“পথ খাটো না দীর্ঘ, সেসবও তো ঠিক করে দেবে এই বন্দুকের নল।“ রাইফেলটার নলটা দেখিয়ে বলল সাদ্দাম। তারপর রাইফেলটাকে আগের গোপন জায়গায় রেখে দিয়ে সাদ্দাম বলল, “আতিফ, তোর ‘ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন’এর কী খবর?”
“এখন কিছুটা থমকে গেছে।“
“কেন!” অবাক চোখে তাকায় সাদ্দাম।
“কেন বলতে ইউনিটে বাঁধা। আমাকে এখন ওসব বাদ দিয়ে অন্য কাজে বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে।“
“এ জন্যে কে কলকাঠি নাড়ছেন? আর জে এফ’এর কেউ না অন্য কোনো ইউনিটের কেউ?”
“আইএসআই। আইএসআই মায়ানমার পার্লামেন্ট আক্রমণের জন্যে ‘স্মাইলিং ইব্রাহিম’ নামের এক নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। আর এর দায়িত্বে রয়েছেন আইএসআই’এর জুনিয়ার ফিল্ড ব্রাঞ্চ অফিসার লেফটেন্যান্ট মজিদ ভাট। এই প্রজেক্টের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে ন্যস্ত করেছেন। আমাকে এখন ‘স্মাইলিং ইব্রাহিম’ নিয়েই মাথা ঘামাতে হচ্ছে। আমাদের তো কিচ্ছু করার নেই। আমরা তো পাশার ঘুটি মাত্র। যেভাবে চালবেন, সেভাবে চলতে হবে।“ আতিফের কথায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
“কিন্তু, তুই তো ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপের কাজটা ভালোই করছিলি। ওতে তো আমাদের পক্ষে ভালোই সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল। সু চি’র উপর তো ভালোই আন্তর্জাতিক চাপ আসতে শুরু করেছিল।“
‘ওঁর শান্তির নোবেল প্রাইজটা ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিটা কেবলই জোরালো হচ্ছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপও আসতে শুরু করেছে। আমি মনপ্রাণ দিয়ে এই কাজটাই করতে চাইছিলাম, সু চি যে একজন ভেকধারিনী শান্তির নেত্রি, সে মুখোশটা খুলে দিতে চাইছিলাম। কিন্তু আমাকে ওকাজ থেকে বিরত করে রাখা হলো। আমাকে এখন আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করতে হচ্ছে।“
“অং সান সু চি যে কট্টর ইসলাম বিরোধী বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু আর সামরিক জান্তার অঙ্গুলিহেলনেই কাজ করছেন, সেটা কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক মহল আঁচ করতে পারছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, সু চি অহিংস মতবাদে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও, শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়া সত্ত্বেও, রোহিঙ্গা গণহত্যা সম্বন্ধে কেন কোনো উচ্চবাচ্চ করছেন না? কেন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটাও টু শব্দ ব্যয় করছেন না? তাঁর চোখের সামনে এই নৃশংস গণহত্যা অহরহ ঘটা সত্ত্বেও কীভাবে তিনি চুপ থাকছেন? অনেকেই বুঝে গেছেন, তাঁর মুখে বুদ্ধের ভড়ং আর মনে কার্তুজের চারণ।”
“উল্টে তিনি রোহিঙ্গাদের ঘাড়েই দোষ চাপাচ্ছেন! বলছেন, রোহিঙ্গারা নাকি জঙ্গি! রোহিঙ্গারা নাকি তাঁর দেশের পক্ষে বিপদ!”
“তিনি যে তলে তলে ‘রোহিঙ্গা খ্যাদাও অভিযান’এর মূল চক্রী, তা মনে হয় কেউ জানেন না। আরে রোহিঙ্গারা জঙ্গি হলেও তো তোমাদের দোষেই হয়েছে, নাকি? তুমি ঘরবাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে পুড়িয়ে দেশ থেকে মেরে ধরে তাড়িয়ে দেবে, ধরে ধরে কচু কাটা করে কাটবে, আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরব? তুমি আমার বংশ, আমার জাত, আমার ধর্ম নিশ্চিহ্ন করে দেবে, আর আমি বীণা হাতে গান করব? চুলের মুঠি আমরাও ধরতে জানি। আমরাও জানি বন্দুকের নলকে কীভাবে কথা বলাতে হয়।“ গায়ের রগ টানটান হয়ে ওঠে সাদ্দামের।
“আমরা বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রসংঘে দাবি তোলার চেষ্টা করেছিলাম, রাখাইন আমাদের আদিপুরুষের ভিটে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যুগযুগ ধরে এদেশে বাস করে আসছেন। আমরা ইতিহাসের দলিলও পেশ করেছিলাম। কিন্তু সু চি’র সরকার সেসব মেনে নেয়নি। আর এসবের পেছনে ইন্ধন জোগাচ্ছে চীন।“
“রাষ্ট্রসংঘ তো আমাদের দাবি মেনে নিয়েছেন। তাঁরা তো জোর গলায় বলে দিয়েছেন, সমস্ত রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে।“
“কিন্তু, জাঁদরেল মিয়ানমার সরকার কি সে দাবি এত সহজে মেনে নেবে? আদৌ মেনে নেবে না। এই তো সেদিন পাকিস্তান ঘুরে এলাম। পাকিস্তানও আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রীও আমাদের পক্ষে জোরাল সওয়াল করেছেন। এমনকি রাষ্ট্রসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতও বলেছেন, সু চি’র এবার ঘুম ভাঙা দরকার। কিন্তু মায়ানমার সেনা আর সু চি, সেদিকে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে লাগাতার রোহিঙ্গা নিধন করেই যাচ্ছেন! তাঁদের এত সহজে জব্দ করা যাবে না।“
“সেজন্যেই তো হাতে বন্দুক তুলে নেওয়া। বাঁকা ঘাড়কে কীভাবে সোজা করতে হয়, সেটা একমাত্র বন্দুকের নলই জানে।“ সাদ্দামের কণ্ঠে বারুদ জ্বলে ওঠে। আতিফ সে বারুদে ঘি ঢালে, “বন্দুকের জবাব বন্দুকই দেবে। গোটা মিয়ানমারকে বার্মিজ সেনাদের কবর বানিয়েই ছাড়ব। সু চি ও টের পাবেন, হিংসা কাকে বলে। মৃত্যুযন্ত্রণা কী। ধ্বংসের ভয়াবহ রূপ কেমন। একবার আগুনে ভস্ম হওয়া ছাই, দ্বিতীয়বার আগুনে পুড়লে কী বীভৎস হতে পারে।“
বাইরের হিমঠান্ডা বাতাস ঝিরঝির করে ভেতরে ঢুকছে। বৃষ্টি প্রায় থামার মুখে। ছেড়ে যাওয়ার আগে ময়দা চালার মতো করে গুঁড়িগুঁড়ি করে ঝরছে। চরাচরের ক্যানভাসে দিয়ে যাচ্ছে শেষ তুলির টান। ত্রিপলের চাটায় ঘেরা ঘরের বাহিরটা যত ঠান্ডা ভেতরটা ততই গরম। আতিফ ও সাদ্দাম দুজনেই এখন তেতে ‘টং’ হয়ে গেছে। যেন ফুলকি ওঠার আগের তপ্ত বারুদ।
“ঝড়টা এবার থামল মনে হয়।“আতিফ জানালায় মুখ বাড়াল। সাদ্দাম বলল, “আমেরিকা কী বলছে? তুই তো রাষ্ট্রসংঘে ওদের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেছিস?”
“ওদেরও একসুর। আমেরিকা চায়, মায়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরাক।“
“এত আন্তর্জাতিক চাপ সহ্য করেও সু চি’র সরকার মুখে কুলুপ এঁটে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে!”
“শুধু কী কুলুপ, মুখে ঠুসি, চোখে ঠুলি আর কানে তুলো গুঁজে বসে আছে। এদের না আছে হৃদয় না আছে মন। এরা মানুষ খেকো দানব। পিশাচ অসুর। মুখে এদের নাম নেওয়াও পাপ।“ মনে মনে খিস্তি দিতে দিতে উন্মুক্ত দরজাটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল আতিফ। আকাশ রঙ বদলাতে শুরু করেছে। মোষের মতো কালো মেঘটা কেটে নীল বুকে একটা একটা করে ফুটছে তারা। আতিফ আকাশে একটা একটা করে যেই তারা ফুটতে দেখছে, আর অমনি কষ্টের ফাঁক দিয়ে ঠিকরানো আনন্দ তার মনে উতলে উঠছে। ভাবছে, মতিভাইরাও নিশ্চয় এতক্ষণে নিজেদের সামলে উঠছে। আমাদের নৌকোটা আবারও বৈঠা ঠেলে ভাসতে শুরু করেছে। আতিফ, আবারও মেঘ কেটে কেটে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “একটাই আকাশ অথচ কত তার রঙ কত তার ঢং!”
“মানুষের মনও তো এই বদলে বদলে যাওয়া আকাশের মতোই।“ পেছনে এসে দাঁড়াল সাদ্দাম।
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস।“ মাথা নড়াল আতিফ।
“সত্যি মানুষের মন মাপা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কখন যে কীভাবে বদলে যায়, তা মনে হয় শরীরও জানতে পারে না!”
“আমার মনে হয়, শুধু আকাশ নয়, মানুষের মনে একটা গিরগিটিও থাকে। মুহূর্তে বদলে নেয় রঙ। এই যেমন আমাদের নেত্রী সু চি, বহির্বিশ্বে একরূপ আর নিজের দেশে আরেক রূপ! ক্ষমতায় থাকলে এক চরিত্র আর ক্ষমতায় না থাকলে আরেক চরিত্র!”
“আসলে মানুষ বিরোধী আসনে থাকলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যতটা হম্বিতম্বি করে, নেকড়ের মতো হামলায়, গর্জায়, ক্ষমতায় এলে ঠিক ততটায় ‘বিড়াল’ হয়ে যায়! তখন ওই যে বললি না, মুখে ঠুসি, চোখে ঠুলি পরে আর কানে তুলো গুঁজে বসে থাকা আর কী।“ সাদ্দাম ভেজা গামছাটা পাক দিয়ে চিপতে চিপতে বলল। আতিফ জিজ্ঞেস করল, “এখন বেরোনো যাই না?”
“কোথায়!” সাদ্দামের চোখে বিস্ময়।
“নাফ নদীতে। মোহনার দিকে।“
“এখন! তোর মাথা সত্যি গেছে!”
“কেন? এখন কী সমস্যা? ঝড়-বৃষ্টি তো থেমে গেছে। আকাশে তারাও ফুটতে শুরু করেছে।“
“শুধু তারা ফুটলেই হবে? মানুষের চোখ ফুটতেও তো হবে। যাদেরকে হাত করে স্পিডবোট ম্যানেজ করব, তারা যে এখন ঘুমিয়ে কাদা। হাত আর পা নিয়ে তো আর যাওয়া যাবে না? নদীর ব্যাপার। পানির ব্যাপার। এ তো আর গাছের ফল না যে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে?“
“কিন্তু এখন গেলেই ভালো হতো রে। ঝড়-বৃষ্টিতে কী যে হলো, কিছুই তো বুঝতে পারছি নে।“ দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছে আতিফের মনে। সে আশঙ্কা করছে, যে গতিতে ঝড়-বৃষ্টিটা হলো, তাতে আব্বাদের নৌকোটা কি আদৌ জলে ভেসে থাকতে পেরেছে? এই দুর্যোগে জান নিয়ে বেঁচে আছে? ঝড় যা বলছে, তাতে তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। স্রোতে উল্টে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আব্বার শেষ ইচ্ছেটা মনে হয় আর পূরণ হলো না! আকাশের কালো মেঘ যত কেটে যাচ্ছে, মনে আশংকার কালো মেঘ তত জমছে আতিফের। আর একদণ্ডও মন টিকছে না এখানে। মন শুধু ‘আব্বা-মা, ভাই-ভাবি’ গাহাচ্ছে।
“ওঁরা নিশ্চয় মেঘ দেখে পাড়ে নৌকো ভিড়াবেন। যদি নৌকো পার ঘেষা থাকে, তাহলে কিচ্ছু হবে না।“ বলল সাদ্দাম।
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন
এসএন