ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৪
নেই দেশের নাগরিক
সম্মতিটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে লাফিয়ে পড়ল আবুল। আসলে এত সূক্ষ্ম ফন্দি আবুলের মতো মোটা মাথার লোকের পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়। ফন্দিটা ইয়াসিন মাস্টারের বউ নাসরিন বানুর মাথা থেকে আসা। তিনিই আবুলের কানে ফুঁসটা দিয়েছিলেন। নৌকোদুটো আলাদা হয়ে গেল। নৌকোর গা লাগালাগি খোল দুটোও সে কথা বলছে। হাঁড়ির কালির মতো কালো রঙের খোল দুটো যেখানে গা ঠেসে লেগেছিল, সে জায়গাটায় জলের ছাট না লেগে কিছুটা ফ্যাকাসে কালো হয়ে গেছে। ইট দিয়ে ঘাস চাপা দিয়ে রাখলে ঘাসগুলো যেমন ফ্যাকাসে হলুদ হয়ে যায়, এখানেও সে রঙের কিছুটা আভা আছে। দুই নৌকোর দুই খোলে মুখ ভাড় করে জুবুথুবু হয়ে পড়ে আছে গোটানো রশি। রশির গা চুঁইয়ে পড়ছে চোবড়ানো জল। যেন রশি কাঁদছে! হাউমাউ করে কাঁদছে! রশি তো বাঁধনে থাকলেই সে রশি, তা নাহলে তো সে নারকেলের ছোবড়া। বাঁধনে না থাকলে, তার না থাকে জাত, না থাকে ধর্ম। বাঁধন খোলা রশি যেন রুহু ছাড়া শরীর। নড়ে উঠল ভিন্ন হওয়া নৌকোটি। দুই নৌকোর মধ্যবর্তী ফাঁকটা একটু একটু করে সিঁথি হতে হতে ফাড়ি হয়ে উঠছে। আবুল গা ঘামিয়ে ঘুঁত ঘুঁত করে বৈঠা টানছে। তাদের নৌকোর ঠেলা জল নদী হাতড়ে হাতড়ে দূরে ঠেলে দিচ্ছে নুহুদের নৌকোটাকে। ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে আবুলদের নৌকো। মতি আচমকা হাঁক দিয়ে উঠল, “আপনারা কোন দিকে যাবেন?”
ভোরের ফিনফিনে হাওয়াই গড়া খেতে খেতে মিহি করে উড়ে এল, “দেখি, কোন দিকে আল্লাহ নিয়ে যায়।“ রহস্য মাখিয়ে কথাটা শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন ইয়াসিন মাস্টার। নৌকোটা কিছুটা এগোতেই ছই থেকে বেরিয়ে বাইরের পাটাতনে কেবলই দাঁড়িয়েছেন। গলাকাটা সাদা রঙের সুতির গেঞ্জিটা গায়ে দাঁত কামড়ে লেগে আছে। পৌনে ছ-ফুট চেহারাটা নদীর বুকে আসমান ঠেকে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন মনে হচ্ছে, একটা সাদা জিন খাড়া হয়ে ভেসে যাচ্ছে! মতির মুখটা আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ইয়াসিন মাস্টারের হেঁয়ালিমাখা কথাটা তার ল্যাপ্টো মাটির কোমল হৃদয়টাতে একটা পেটে সূঁচ হাঙল!
“ছাড়ো তো লোকের কথা। অত গা পড়ে মেশার কী আছে? পর পরই হয়।“ গা ঝাড়া দিয়ে উঠল নুহু। বৈঠাকে শক্তিভর পাক মেরে নৌকোটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে সে। ইয়াসিন মাস্টারদের নৌকোটা পিছনে ঘুরে আবার উচিপুরং’এর দিকে যাচ্ছে। নুহু তাদের নৌকোটাকে সেদিকে না গিয়ে নাক সোজা টান মারল। মতি জিজ্ঞেস করল, “কোন দিকে যাচ্ছিস?”
“মরণের দিকে।“ হেস মারল নুহু। আরিফা চ্যাটাং করে উঠে বলল, “দেওরজি, তুমি হেঁয়ালি করতে পারও বটে! এখন কি হেঁয়ালি করার সময়? তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না!”
“ওর খুব রস জমেছে। থাম, চাল কটা ফুরোক, তখন সব রস বিষ হয়ে যাবে! তখন ওর এই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা বেরোবে।“ দাঁত খিটিমিটি করে মতি। দুঃখ আর রাগ, তেল আর বেগুনের মতো মিশে, ছ্যান ছ্যান করে উঠছে। প্রথমে সেভাবে খেয়াল করেনি মতি। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ইয়াসিন মাস্টারদের সাথে এই ঘণ্টা কয়েকের মিলমিশ তাকে বড় দায়েদি করে তুলেছিল। লোকগুলোকে তার বড্ড ভালো লেগে গেছিল। এত কাছের হয়ে গেছিল যে হুট করে বিচ্ছেদটা মতি মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। তার মন বলছে, ওদের নৌকোটা নিশ্চয় ফিরে আসবে। ফিরে এসে আবুল নুহুকে একটা বিড়ি দিয়ে বলবে, নুহুভাই বিড়িটা ধরাও তো, একটা সুখটান দিই। ইয়াসিন মাস্টার বলবেন, জীবনের শেষ কটা ঘণ্টা আর একা থেকে কী করব, তার চেয়ে বরং কুটুম-দায়েদিদের সঙ্গে কাটানোই ভালো। আল্লাহ কষ্ট সহ্য করার সকুন দেবেন। ‘কুটুম’ ‘দায়েদি’ বলাই মতির মনটা খোলামকুচির মতো ড্যাং করে নেচে উঠবে। মনে মনে বলবে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কুটুমই তো, আমরা তো কুটুমই। এক ঘাটে জড় হওয়া সব দেশ ছাড়া মানুষগুলোই একে অপরের কুটুম, দায়েদি, আত্মীয়পরিজন। ইয়াসিন মাস্টারদের নৌকোটা বিন্দুর মতো হয়ে এলে, আচমকা মতির টনক নড়ল, আবারও জিজ্ঞেস করল, “আরে তুই নৌকো কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস!”
“কেন? বঙ্গোপসাগরের দিকে। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ!” থুথনি নিচে নামিয়ে কণ্ঠে হাতুড় পিটিয়ে বলল নুহু।
“বঙ্গোপসাগরের দিকে! বঙ্গোপসাগরের দিকে কেন! সমুদ্রে কি ডুবে মরতে যাব নাকি!” চোখ বাটির মতো বড় হয়ে উঠছে মতির। মরতে আর কী বা বাকি আছে! না মরে বেঁচে আছি এই যা। শুধু কয়েকটা শ্বাস নেওয়াই কি বাঁচা? খড়গের মাথায় জানটা কোনোমতে ঝুলে আছে, একে কি আর বাঁচা বলে? বিড়বিড় করে নুহু। মতি তার দিকে চোখ ফেড়ে তাকালে নুহু গড়গড় করে বলল, “শাহপরীর দ্বীপ যাব। শাহপরীর দ্বীপের নাম শোনোনি?”
“হ্যাঁ, শুনেছি, সে তো অনেক দূর!“ ভ্রূ টান করল মতি। তারপর জুলপির কাঁচাপাকা চুলগুলো নাচিয়ে বলল, “তাইই চল। কী আর করা যাবে! কপালে যা আছে হোক।“
দূর! দূর বলে ঘাবড়ে গেলে হবে? শাহপরীর দ্বীপ তাও তো আমাদের জানাশোনা জায়গা। কিন্তু আমাদের ‘দেশ’? সে যে কোন ডাঙা, কোন দ্বীপ তার তো আমরা কিছুই জানি না। আদৌ এ জন্মে আর কোনো ‘দেশ’ পাব কি না সন্দেহ! কথাগুলো নুহুর বিড়বিড়ানি মন থেকে বেরিয়ে বৈঠার গা দিয়ে নদীতে নেমে জলকেলি খেলছে। মতির মনমরা শরীরটা থপথপ করে হেঁটে ছইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। তার গা বেয়ে নেমে আসছে বিহেন বেলা। প্রথম ফোটা আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে নৌকোর খোলে। “বুঁ” করে বেজে উঠল মোবাইলটা। একই সঙ্গে ভিমরুলের ডানার মতো কাঁপছে আবার একটা ক্যাঁচরম্যাচর শব্দও ক্যাচম্যাচ করে উঠছে। বোঝাই যাচ্ছে মোবাইলটা ‘ভাইব্রেট উইথ রিং’ মোডে আছে। সকালের শান্ত নদীর ওপরে হলুদরঙা রোদ চুলের বিনুনির মতো নৌকোর পাটাতনের ওপরে ছড়িয়ে পড়ছে। হাঁটু-মাথা করে বসে থাকা ইয়াসিন মাস্টারের ভেতরটা ‘থক’ করে উঠল! কার ফোন! থড়বড় করে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করলেন। স্ক্রিনটা ঢলঢলে চোখের সামনে ভাসতেই, ইয়াসিন মাস্টারের চক্ষু ছানাবড়া! তিনি একবার মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছেন, একবার দূরে মিলিয়ে যাওয়া মতিদের নৌকোর দিকে তাকাচ্ছেন! ‘আগত’ নম্বরটার প্রত্যেক ডিজিট বারবার চোখ দিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছেন। ঠোঁটের পাতাজোড়া ফড়িং’এর ডানার মতো কাঁপছে। থুথনি আরও সরু হয়ে আছে। ঘাড়ের শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ঠান্ডা স্রোত। ‘এ তো সেই নম্বর!’ মনে মনে বলে উঠলেন ইয়াসিন মাস্টার। ছইয়ের ভেতর থেকে ঠিলিতে আটা চিপে বানানো সিমাইয়ের মতো সরু কণ্ঠটা বেরিয়ে এল, “কে ফোন করেছে গ?”
ছেলেটাকে তো গতকাল ফোন করেছিলাম। পুরো একটা রাত কাবার। আর এখন, এত ঘণ্টা পর ফোন ব্যাক করছে! তবে মনে হয়, ছেলেটার মোবাইলে ‘মিসডকল অ্যালারট’ করা আছে। ফোন ‘অন’ করে ‘মিসডকল’ দেখেই, সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক করেছে। কিন্তু এখন আর কল রিসিভ করে কী হবে, ওরা তো অনেক দূরে চলে গেছে। এখন তো আর ডেকে বলা যাবে না, ওগো, মতিভাই, নুহুভাই, তোমাদের ছোটভাই ফোন করছে। গলার আওয়াজ অতদূর পৌঁছবে না। এসব ভাবতে ভাবতে রিংটা কেটে গেল!
“কার ফোন ছিল মাস্টারভাই?” আবুলের মুখ থেকে কথাটা বের হতে না হতেই, আবারও ফোনটা ‘বুঁ’ করে গেয়ে উঠল। ইয়াসিন মাস্টার দুনুমুনু করতে লাগলেন, রিসিভ করব না করব না। বলতে বলতে থতমত করে সবুজ বোতামটায় আঙুলের চাপ পড়ে গেল তার। “হ্যালো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই নম্বর থেকে মিসডকল গেছিল। না, আমাকে চিনতে পারবেন না। আসলে আপনার ভাই মতি আর নুহু’রা ফোনটা করেছিলেন। ওরা? ওরা কিছুক্ষণ আগেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এই মিনিট পনের হলো, ওরা অন্য দিকে চলে গেলেন। আমরা? আমরা এখন, নাফ নদীতে নৌকোর ওপর। মতিরা? ওরাও এই নদীর ওপরেই আছেন। ওরা এই নয়াপাড়ার উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে চলে গেলেন, আর আমরা উচিপুরং’এর দিকে যাচ্ছি। কে? ওহ, আপনার আব্বা, নাহ, এখনও মারা যাননি, তবে অবস্থা খুউব খারাপ, কখন কী হয়ে যায়, বলা মুশকিল, ধুকধুক করছেন। ওরা? হ্যাঁ, ওরা শাহপরীর দ্বীপের দিকেই যাচ্ছে মনে হয়। হ্যালো, হ্যালো, যাহঃ লাইনটা কেটে গেল!”
ছয়
‘ধুর! ফোনই লাগছে না!” বিরক্ত হয়ে উঠল আতিফ। বার কয়েক চেষ্টা করে নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্যে আর ফোনটা লাগাতেই পারল না । “ফোনটা কে ধরেছিল? লোকটা কি তোদের চেনাজানা?” কালো রঙের শার্টের ওপর জলপাই রঙের খাকিটা চড়াতে চড়াতে জিজ্ঞেস করল নবী। আতিফ বারবার চেষ্টা করে একটি বারের জন্যেও ফোনটা না লাগাতে পেরে হতাশ হয়ে নেতানো দড়ির মতো বাদামি রঙের সোফার ওপর গা এলিয়ে দিয়েছে। সোফাটার গায়ে ইতস্তত সবুজ রঙের ঝাউপাতা। মাঝে মধ্যে হলুদ সূর্যমুখী ফুল আঁকানো। একটু দূরে কালো রঙের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আসলে এতবার চেষ্টা করেই বা কী হবে, ইয়াসিন মাস্টারের মোবাইলটা যে চার্জ ফুরিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
“তোর আব্বারা কোথায় আছে বলছে?” খাকিটার ভেতরে দুই হাত গলিয়ে দিল নবী।
“নাফ নদীতে, নৌকোর ওপর।“
“লোকেশন?”
“নয়াপাড়া ছেড়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাচ্ছে।“
“তাহলে গন্তব্য হয় শাহপরীর দ্বীপ আর না হয় সেন্টমারটিন্স দ্বীপ।“
“তা ছাড়া তো ওদিকে আর অন্য কোনো দ্বীপ নেই। আচ্ছা, ওরা নয়াপাড়া ক্যাম্প ছেড়ে সমুদ্রের মাঝে শাহপরীর দ্বীপে যাবে কেন? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।”
“কেন, তুই খবর শুনিসনি?”
“কী খবর?”
“বাংলাদেশ সরকার আর নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দিচ্ছে না।“
“সে তো কুতুপালং আর থাংখালীতে ঢুকতে দিচ্ছে না।“
“এখন সব জায়গাতেই একই অবস্থা। ওরা নাকি আর শরণার্থীদের চাপ নিতে পারছে না। ওদের নাকি নাভিশ্বাস ওঠার দশা। খাদ্যের জোগান দেওয়া নাকি অসম্ভব হয়ে উঠছে।“
“কিন্তু, রাষ্ট্রসংঘ তো সাফ বলে দিয়েছে, কোনো শরণার্থীকেই ফেরানো যাবে না।“
“ওসব কথার কথা। কথার সঙ্গে কাজের বিস্তর ফারাক। রাষ্ট্রসংঘের কথা কান করলেই তো। রাষ্ট্রসংঘ তার বুলি বলে যাচ্ছে, আর এদিকে বিজিবি তার কাজ করে করে যাচ্ছে।“
“তাহলে কি সীমান্ত সব সিল করে দিয়েছে বাংলাদেশ!”
“হ্যাঁ।“ কোমরের বেল্টটা টাইট দিতে দিতে ঘাড় নড়াল নবী। আতিফ আঁতকে উঠল, “সর্বনাশ!” সোফা থেকে তড়বড় করে উঠে বলল, “তাহলে আব্বাদের কী হবে! ওরা তো কোনো ক্যাম্পেই উঠতে পারবে না! না খেতে পেয়ে নদীতে ডুবে মরবে!”
“মাথা ঠান্ডা কর, আতিফ।“ আতিফের পিঠে হাত রাখে নবী। বলে, “ঠান্ডা মাথায় ভেবে কোনো বুদ্ধি বের করতে হবে।“
“কী করা যায় বলতো?” অসহায়ের মতো বলে আতিফ। তার চোখ ছলছল করে আসছে।
“কাজটা তো খুব কঠিন। খুবই দুরহ।“
“যত কঠিনই হোক, পথ খুঁজে বের করতেই হবে।“
“প্রথমে খোঁজ নিতে হবে, নাফ নদীর তীরবর্তী বাংলাদেশের কোনো বর্ডার খোলা রয়েছে কিনা। তারপর……… ।“ নবীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই, আতিফ বলল, “বর্ডার খোলা থাক বা না থাক চোরাবর্ডার দিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে।“
“সে তো পরের কথা। দরকার হলে সেটাও করতে হবে। সব আগে নদীতে নেমে চাচাদের খুঁজে বের করতে হবে। সেটা চাট্টেখানি কাজ নয়? হাজার হাজার নৌকোর মধ্যে বেছে বেছে তোর আব্বাদের নৌকোটা খুঁজে বের করা মানে, খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার সামিল।“
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন