বই আলোচনা
মোস্তফা কামালের ‘জননী’: জীবনের অনন্য আখ্যান
‘মা’ আমাদের সবারই অনুভূতির একটি বড় অংশ জুড়ে থাকেন সবসময়। তাই হয়তো পৃথিবীর অধিকাংশ কবি-লেখক মাকে নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য অনুভূতি ও ভাবনা। মাকে নিয়ে ভাবনার জায়গাগুলো বোধহয় জগতের সবারই এক। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মোস্তফা কামালও মাকে নিয়ে লিখেছেন ভিন্নমাত্রিক উপন্যাস। তাতে তুলে ধরেছেন জননীর অবিনশ্বর ও চিরন্তন অবয়ব। উপন্যাসের পাতায় পাতায় মেলে ধরেছেন জীবনের অনন্য এক আখ্যান।
মোস্তফা কামাল লেখালেখির স্বপ্নে বিভোর থাকা একজন স্বপ্নময় মানুষ। বলা যায়, সাহিত্যের প্রেমে বিভোর পুরুষ তিনি। এ প্রেম কিংবা স্বপ্নের হাত ধরেই তিনি লিখেছেন অসংখ্য বই। তার একটি ভিন্নধর্মী সৃষ্টিকর্ম ‘জননী’। উপন্যাসের গল্পটি গড়ে উঠেছে একজন দুঃখী মায়ের জীবনের গল্প নিয়ে। গল্পটির মূল চরিত্রে মধ্যবিত্ত এক মমতাময়ী মা সানজিদা বেগম। তার স্বামী মোহাম্মাদ আলীর সংসারের প্রতি দায়িত্ব পালনে প্রচণ্ড অনীহা। ঘটনাক্রমে একসময় তার স্বামী পীরের দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করলে শুরু হয় শিশুদের নিয়ে জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকা একা এক নারীর লড়াই।
একসময় স্বামীকে খুঁজে পেলেও তিনি সংসার পরিচালনায় অপরাগতা প্রকাশ করলে মানসিক যন্ত্রনায় ও সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তায় ভেঙ্গে যেতে যেতেও আকড়ে ধরেন মাটি, সন্তান কিংবা সংসার। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে সামান্য নুনের জন্যেও তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে, পাড়ি দিতে হয়েছে একাই এক বিশাল সমুদ্র। যেখানে হাত ছুঁয়ে অনুপ্রেরণা দেয়ার মতোন ছিল না কেউ। বরং বিভিন্নভাবে নিকট আত্মীয়দের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন মা সানজিদা বেগম। তবুও হাল ছেড়ে না দিয়ে সংসার বৈঠা ধরেছেন আরও শক্ত ভাবে আরও প্রবল চিত্তে।
উপন্যাসের এক পর্যায়ে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে খুব কম বয়সে বড় ছেলে ইকবালের বিয়ে করার মধ্য দিয়ে গল্পে সন্তানদের মাতৃ-বৃত্তের বাইরে যাওয়ার সূচনা হয়। মা কেন্দ্রীক জীবনের বাইরে শুরু হয় অন্য এক জীবন, জগত ও কঠিন বাস্তবতার গল্প। এ গল্পে লেখক মোস্তফা কামাল উন্মোচিত করেন আমাদের অজস্র পরিবারের ভেতরকার নিত্যদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা। গল্পের একসময়ে প্রিয় সন্তানের মায়ের প্রতি অবহেলা, পুত্রবধূর কারণে সংসারে বিভিন্ন বিবাদ-বিচ্ছেদ সৃষ্টি এবং ছোট ভাইবনদের প্রতি বড় ভাইয়ের অবহেলার ছবি পর্যায়ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে এবং তাদের জীবনের বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্ত।
লেখক মোস্তফা কামাল তার ‘জননী’ উপন্যাসে তিন প্রজন্মের গল্প, জীবন যাপন ও বাংলার একটি গ্রামীন যৌথ পরিবারের ভাঙা-গড়ার গল্প তুলে ধরে ধরেছেন। তবে উপন্যাসে একসময় দেখা যায়, মায়ের বৃত্তের বাইরে কেউই যেতে পারেনি। মাকে অবহেলা করার পরিণতি সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়েছে সন্তানেরা। সন্তানেরা দূরে থাকাকালীন তাদের বিবর্ণ জীবনে সানজিদা বেগম হয়ে উঠেছেন আরও গাঢ় রঙ তুলি। মাকে ছেড়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও ব্যর্থ হয়ে আবার সেই মায়ের কোলেই আশ্রয় নিতে হয়েছে তাদের। শুধু সন্তান নয়, নাতনীদেরও আগলে রেখেছেন মমতায়। সব সংকট কিংবা ঘাত-প্রতিঘাতে শেষ দিনটি পর্যন্ত মা-ই প্রবলভাবে আগলে রেখেছে সকল সন্তানকে।
মোস্তফা কামাল তার ‘জননী’ উপন্যাসে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। গল্পে ফুটে উঠেছে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে বাংলার মানুষের দুর্দশা কিংবা একমুঠো খাবারের জন্য সাধারন মানুষের হাহাকারের চিত্র। একটি পরিবারের টিকে থাকার লড়াই ও সময় কিংবা সম্পর্কের বিবর্তন। একজন মা এবং একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে টেনে তুলে ধরার গল্প।
মোস্তফা কামালের ভাবনায় জগত সংসারে সবচেয়ে ত্যাগ স্বীকার করা এক মমতাময়ী জননীর জীবনলেখ্য এই উপন্যাস। যা পৃথিবীর সব সন্তানদের জন্য এক উপযোগী গ্রন্থ। এ উপন্যাসের জননীর ব্যক্তিত্ত্ব আর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে জয়ী সানজিদা বেগমের গল্প রয়েছে আমাদের আনাচে-কানাচের প্রতিটি ঘরে। আমাদের প্রত্যেকের মা-ই হয়ত কোনো না কোনোভাবে মোস্তফা কামালের জননী উপন্যাসের সানসিজা বেগমের প্রতিচ্ছবি।
জননী
লেখক: মোস্তফা কামাল
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশক: পার্ল পাবলিকেশন্স
দাম: ৪০০ টাকা