ফকির ইলিয়াস
একগুচ্ছ কবিতা
কেঁপে ওঠা কংক্রিটের গান
কে দ্রুতগামী আর কে স্রোতগামী তা এখন আর
খুঁজে দেখি না। বরং যে নীরবে বসে আছে
এই বৃক্ষছায়ায়,
যে কারো জন্যেই অপেক্ষা করছে না
তাকেই আমার পরম শান্তিময় মানুষ মনে হয়।
জগতে কেউ কারো জীবনাংশের ছায়ামূর্তি
হতে পারে না। যেটুকু আমরা দেখি—
তা কেবলই ছায়াময় আলোর কারুকাজ।
মরুভূমিতে ঝড় এলে উড়ে যায় যে
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরখণ্ড; তা-ও কাঁপতে কাঁপতে
পুনরায় পতিত হয় মাটিতে। আর সাবালিকা
সন্ধ্যা; সেই কম্পন ধারণ করে
মহাযুগের কাঙ্খিত পাতায়।
মানুষও এককালে পাথর ছিল,
অথবা পরজনমেও পাথর হয়েই ভাসতে পারে
সমুদ্রে, এমন কথাবলির আড়ালে ক্রমশ
লুকোতে থাকে পৃথিবীর ছায়া।
উত্থানের উত্তরপর্ব
জীবনের উত্থানগুলো সবসময়ই রক্তাক্ত হয়।
যারা জাগরণের পক্ষে পুরো আয়ুই
জমা রেখে দিন কাটায়—
তারা জানে আরেকটি জনম পেলেও
কাজগুলো শেষ করে যাওয়া যেত না।
একটি বিশুদ্ধ পৃথিবীর জন্য নির্মাণ করা
যেত না আরও কয়েকটি গোল গোল চাঁদ!
তবু মগ্নতার মায়া কারো কারো জন্য
পথে পথে সাজিয়ে রাখে নিশ্বাসের বনস্পতি।
কিছু কিছু স্ফূলিঙ্গ দেখে প্রজন্ম হাত তোলে।
কিছু কিছু প্রজাপতি ডানায় ডানায় ফেরি করে
মেঘ আর মোমের রঙ। ঘুরোঘুরি করে
মানুষের আশেপাশে।
জীবন রঙ ভালোবাসে। আর তা যদি হয়
রক্তের রঙ—তাহলে ধরে নেয়া যায়
নতুন সূর্য উঠবেই। নতুন পাতাময় বৃক্ষ
আবার ছায়া দেবে মানুষকে।
বিপরীত বৃত্তবিলাস
যতই জমা থাক এই বেদনার বিন্দু।সিন্ধু থেকে যে মেঘ
উড়ে উত্তরে আসে। শেষে, তা-ই ঝরে করুণার বৃত্তবিলাস হয়ে।
নিয়ে বুকের সাহস-সমগ্র আকাশের। ঢের ছায়া-বিক্রেতা যে
সুবোধ সমুদ্র। ক্ষুদ্র আলো নিয়ে সে-ও দেখায় পথ-প্রজন্মের
দুটি হাতে হাতে। দিতে আরও কিছু জ্যোতি; পাখিরাও গান
ভালোবেসে দান করে কন্ঠের সুর।নুপুর পায়ে দিয়ে আসে
এক কিশোরী, আর বলে তোমাকেও প্রেম দেবো—হে মাটি
দেবো এক বিপরীত দুপুর।
প্রাকৃতিক পরম্পরা
আমাকে বশ করে রাখে একটুকরো প্রাচীন আগুন।
ভ্রূণ কিংবা ভ্রমণ—যা-ই বলো, সবই তো এই
আগুনের ছায়া। মায়া নিয়ে যারা আসে কাছে,জানে
তারাও কোনো বৃক্ষই মানুষের প্রতিপক্ষ নয়। হয়
সুহৃদ তার—না নয় প্রকৃতিক সহোদর জেনে।
শুভক্ষণে, কথা ছিল মানুষও গাঁথবে সেই ধারা পরম্পরা।
যারা দেখবে এই মহেন্দ্রক্ষণ অথবা দেখতে চাইবে না
যারা। ইশারা করেই যাবে মহাকাশ—এই বিশ্বে মানুষই
সকল শুভকর্মের উজ্জ্বল তারা।