ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ৩
অঘ্রানের অন্ধকারে
পর্ব: ৩
‘কতক্ষণ লাগবে আর?’
হাসানকে জিগ্যেস করলাম। সে খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নিচুস্বরে বলল, ‘দশটা, সাড়ে দশটার ভেতর পৌঁছে যাব, স্যার। সামনে জ্যাম নাই।’
বোতলে পানি আছে। ঢকঢক করে পানি খেলাম। গাড়িতে বসে নেটে নানারকম ঘাটাঘাটি করার অভ্যাস আমার নেই। মাঝেমধ্যে গান শুনি। বেশিরভাগ সময় বই পড়ি। তুরির লেখা নোটবুক খুললাম। কবিতার পর সে কী লিখেছে পড়া শুরু করলাম।
“চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেছি। আজ আমার বাসর রাত। এই রাত নিয়ে মেয়েদের এক ধরনের ভয় আর চাপা উত্তেজনা থাকে। স্বপ্ন মেশানো গোপন আনন্দ থাকে। আমার ছিল প্রবল কৌতূহল। যার সাথে বিয়ে হয়েছে আমার, সে অতি পরিচিত। তার নাম শাবিন।
অনেক আগে পরিচয়। এক অফিসে কিছুদিন চাকরিও করেছি। মাঝে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম ইচ্ছে করেই। মনে হয়েছিল বাবা আমাদের বিয়ে মেনে নেবেন না। শাবিন অতি সাদামাটা সাধারণ একজন ছেলে। এমনও হতে পারে শাবিনকে গভীরভাবে ভালোবাসেছি। আমার জীবনে মারাত্মক এক দুর্ঘটনা আছে। সেই দুর্ঘটনার কথা শাবিনকে বলিনি। আবার ভেবেছি শাবিনকে বিয়ে করলে আমার ভালোবাসাকে ঠকানো হবে। তবে এটাও ঠিক, বেশিরভাগ মানুষ স্বাভাবিক ব্যাপার সহজভাবে নিতে পারে না। শাবিনের কিছু জানার কথা না। তবু ভয় হয়, সে কি কিছু জেনেছে কিনা।
ভীষণ অবাক হয়েছি, আমার স্বামী আমাকে চড় মেরেছে। সে চড় মেরেছে খুব জোরে। আমার গাল জ্বলতে শুরু করেছে। গাল জ্বলার ব্যাপারটা প্রথমে টের পাইনি। এতটাই অবাক হয়েছি যে ঘটনা কী ঘটেছে ঠিকঠাকমতো বুঝতে পারিনি। চড় খেয়ে আমার অপমানিত হওয়ার কথা। আমি হয়েছি বিস্মিত। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে চড় আমার গালে বসে যায়নি। তার হাত ঠাস করে গালে লেগে ক্লান্ত হয়ে পড়ে গেছে।
রাত হয়েছে অনেক। বিছানায় জুবুথুবু হয়ে বসে আছি। সে আসে না। সে আছে ঘরের বারান্দায়। দরজা লাগানো। উঠে গিয়ে শাড়ি বদলে এলাম। সে এলো না। আশঙ্কা হলো সে কি আমাকে কিছু বলতে চায়! আমার দুর্ঘটনা বা অন্য কারও সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে এমন কথা? কীভাবে আামাকে বলবে সেটা গুছিয়ে নিচ্ছে। অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে আমাকে বিয়ে না করলেও পারত। তাকে খুঁজে বের করেছি সত্য। এ বাড়িতে নিয়মিত আসার সূত্রে তার মা আমাকে পছন্দ করেছেন। হয়তো শাবিনের মা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। শাবিনের বাবার কোনো খোঁজ নেই। তিনি বহুদিন হলো বাড়ি ছেড়েছেন। মাঝেমধ্যে নাকি আসতেন। আমার শাশুড়ি তাঁর বাবার কাছ থেকে বাড়ি পেয়েছেন। সেই বাড়ির একপাশ তিনি ভাড়া দিয়েছেন। অন্যপাশে আমরা থাকি। বাড়ি ভাড়ার টাকায় সংসার চলে। শাবিনের বাবা মাঝে কয়েকবার এসে আমার শাশুড়ির কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে গেছেন। তারপর তার আর কোনো সন্ধান নেই। শাবিন বলে তিনি এই সংসারের কথা গোপন করে আরেকটা বিয়ে করেছেন। সেখানে সংসার করছেন। বিয়েতে আমাদের বাড়ি থেকে প্রচুর জিনিসপত্র আর নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। হয়তো সেটা শাবিনের মায়ের প্রয়োজন ছিল।
বারান্দার কাছে গিয়ে আস্তে করে দরজা খুললাম। আমার নাকে উৎকট গন্ধ এলো। আচমকা শরীর গুলিয়ে আসছিল। শাবিন বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছে। বারান্দায় বসে সিগারেট খাওয়ার কী আছে বুঝতে পারলাম না। আমরা তো একসাথে স্মোক করেছি। সিগারেটের গন্ধ আমি চিনি। এই গন্ধ অন্যরকম। আমার অপরিচিত। আবার মনে হলো পরিচিত, খুব পরিচিত।
আলতো গলায় বললাম, ‘ঘরে এসো।’
সে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আচমকা আমাকে ধাক্কা দিলো। তাল সামলাতে না পেরে ঘরের মেঝেতে পড়ে গেলাম।
শাবিন হিসহিস করে বলল, ‘তোকে নিয়ে এসেছে আমাকে আটকাবে বলে। দুমাস হলো টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে। এখন নিজে কামাই করে খাই। ঘরে বসে থাকলে এসব কে এনে দেবে আমাকে?’
আচমকা ধাক্কা খেয়ে অবাক হয়ে গেছি। দুহাঁটু ভাঁজ করে ওঠার চেষ্টা করলাম। উঠতে-উঠতে বললাম, ‘কী হয়েছে?’
তখন শাবিন ঠাস করে আমার গালে চড় মারল। বলল, ‘চুপ কর শালি। একদম চুপ।’
ছিঃ কী নোংরা কথা। ঘেন্নায় আমার গা রিরি করে উঠল। শাবিনের কোনো বিকার নেই। আমার দিকে হাত বাড়াল। আমার গলায় দেড়ভরি ওজনের সোনার চেইন ছিল। হেঁচকা টান দিয়ে সেটা ছিঁড়ে নিল। কিছু বললাম না। শাবিন দুপা সামনে হেঁটে ধড়াম করে বিছানায় গিয়ে আছড়ে পড়ল। একটু বাদে তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। শাবিন ঘুমিয়ে পড়েছে।
এ আমি কোন শাবিনকে দেখছি। মাঝে যখন তাকে ছেড়ে দূরে ছিলাম তখন কিছু হয়েছে? শাবিন কেন এরকম করছে তা পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হলো না।
তার কাছে আমার সোনার চেইন থেকে গেছে। ইচ্ছে করলে সেটা খুঁজে নিতে পারতাম। কেন জানি ইচ্ছে হলো না। ঘেন্না লাগছিল সেটা আবার ছুঁতে কিংবা গলায় পরতে।”
তুরির লেখা আমাকে আচমকা আচ্ছন্ন করে ফেলল। নোটবুক বন্ধ করে বললাম, ‘আনিস, গাড়ি থামাও। চা খাব।’
আনিস রাস্তার পাশে সাইড করে গাড়ি থামাল। খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘স্যার, চলে এসেছি। তাদের ফোন দেন। কোন জায়গায় যেতে হবে জিগ্যেস করে নেন।’
গাড়ি থেকে নেমে এলাম। জায়গাটার নাম মাসকান্দা। সামনে শহর। অনেকক্ষণ হলো গাড়ির ভেতর বসে আছি। দুপা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। খানিকটা হাঁটা দরকার। আমি নেমেছি সিগারেট খেতে। প্রচণ্ড চায়ের তেষ্টাও পেয়েছে। রাস্তার পাশের দোকানে গিয়ে দুধ-চিনি ছাড়া চা দিতে বললাম।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করলাম। সিগারেট জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে ফোন এলো। ময়মনসিংহ থেকে ফোন করেছে। বললাম, ‘কাছাকাছি চলে এসেছি। শিগরি পৌঁছে যাব।’
এখান থেকে অনুষ্ঠানের সেই জায়গা কতদূরে অনুমান করতে পারছি না। ঠিকানা জেনে নিয়েছি। আমার এখন আর কোনো তাড়া নেই। তুরির লেখা পড়তে ভালো লাগছে। ময়মনসিংহে পৌঁছানোর আগে পড়ে শেষ করতে পারলে শান্তি পেতাম। পড়া শেষ হয়নি। বাকিটা ফেরার পথে পড়তে হবে। ফেরার পথে সঙ্গে কেউ না এলে ভালো হয়। সঙ্গে কেউ থাকলে অনবরত কথা বলে।
‘স্যার, নতুন কী উপন্যাস লিখছেন?’
‘লিখব একটা। এখনো ঠিক করিনি।’
‘মেলা তো চলে এলো। আর কবে ঠিক করবেন?’
‘আস্তে ধীরে লিখব।’
‘কবিতা লেখেন, স্যার। আপনার লেখায় কাব্যিক ভাব প্রবল।’
গাড়িতে বসে এরকম অপ্রয়োজনীয় কথা হয়। পড়া হয় না। খানিকবাদে সহযাত্রী বলে, ‘স্যার, এখানে গোরুর খাঁটি দুধের চা পাওয়া যায়। খড়ির চুলায় তৈরি। তাতে ধোঁয়ার গন্ধও পাবেন। একদম গ্রামের ফ্লেভার। খাবেন স্যার এককাপ চা? গাড়ি থামাতে বলি?’
‘এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘আপনারা সাহিত্যিক মানুষ। আপনাদের গ্রামীণ ফ্লেভারের দরকার আছে, স্যার।’
‘সেজন্য সকালবিকেল দুবেলা নিয়ম করে গোবরের গন্ধ শুঁকি। আমাদের বাসার পাশ গাভী আছে। এক মহিলা গাভী পোষে। ঘুম থেকে উঠে গাভীর চোনার গন্ধ শুঁকতে যায়। মন শীতল হয়ে আসে।’
এতক্ষণে সহযাত্রী থামে। ঘুমানোর চেষ্টা করে এবং ঘুমিয়ে পড়ে। সে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছে বোঝা যায় নাক ডাকার শব্দে। প্রবল জোরে ঘড়ঘড় শব্দে নাক ডাকে মুখ হা করে। মাঝেমধ্যে মুখ দিয়ে ফ্রুস জাতীয় শব্দ করে ওঠে। মনে হয় ঘোড়ার আস্তাবলে আছি।
সিগারেট শেষ হয়েছে। চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। আনিস গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমরা চলছি। আনিসকে পথের দিকনির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি। বুঝতে না পারলে গাড়ি থামিয়ে কাউকে জিগ্যেস করে নিতে বলেছি।
আমার মাথায় নতুন গল্পের ভাবনা এসেছে। শাবিন আর তুরিকে নিয়ে গল্প লিখব। তার আগে তুরির লেখা নোটবুক পুরোটা পড়ে নিতে হবে।
অল্প সময়ের ভেতর অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে গেলাম। আমরা পৌঁছানোর আরও আধাঘণ্টা পরে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। ভেবেছিলাম, আমার দেরির জন্য অনুষ্ঠান পিছিয়েছে। পরে জানলাম স্থানীয় এমপি আসবেন। তাঁর আসতে দেরি হচ্ছে। তিনি আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি। অনুষ্ঠান উদ্বোধন তিনি করবেন।
আমার কাজ শুধু বক্তৃতা দেওয়া। মুখের ভেতর তেতো হয়ে গেল। কোনোরকমে অনুষ্ঠান শেষ করে গাড়িতে উঠে বসলাম।
আমার সঙ্গে কেউ ঢাকায় আসতে চাইছিল। বললাম, ‘আজ পারব না। আমার অন্য কাজ আছে।’
যে আমার সঙ্গে ঢাকায় রওনা হওয়ার জন্য এসেছিল সে চার বক্স মিষ্টি হাসানের হাতে দিয়ে চলে গেল।
ঢাকায় পৌঁছুতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। রাতে পড়া বা লেখা কিছু হলো না। তুরির নোকবুক পড়লাম পরদিন অফিসে বসে।
(চলবে)
‘অঘ্রানের অন্ধকারে’, দ্বিতীয় পর্ব