জর্দানে প্রভু যিশুর ধর্মীয় তীর্থস্থানে হাজারো দর্শনার্থী
জর্দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত প্রভু যিশুর ব্যাপ্টিজমের তীর্থস্থানে হাজার হাজার পর্যটকের ঢল নেমেছে।
শুক্রবার থেকে কোভিড-১৯ মহামারি রোগের প্রকোপ ও দুর্ভোগের পর থেকে এই খ্রিস্টানদের অন্যতম ধর্মীয় স্থানটি সকলের দর্শনের জন্য বন্ধ রাখার পর খুলে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া, জর্দান ধর্মীয়ভাবে তাদের তীর্থকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের আগমন ও দর্শন ব্যাপকভাবে বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ফলে দর্শনার্থীদের অবারিত আগমন ঘটছে।
‘দ্য ক্যাথলিক ল্যাটিন প্যাট্রিআর্চ অব জেরুসালেম’ জানিয়েছে, প্রভু যিশুর ধর্মীয়ভাবে দীক্ষাদানের বা তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধমীয় রীতিতে দীক্ষা প্রদানের এই অত্যন্ত বিখ্যাত ও প্রচণ্ড প্রসিদ্ধ অবস্থিত ছিল প্রাচীন জর্দান নদীর পূর্ব তীরে। খ্রিস্ট গোষ্ঠীর এই অন্যতম প্রধান তীর্থস্থানটি গণতীর্থযাত্রীদের উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, ‘এই পবিত্র স্থানটি আবারও হতে পারে সম্মিলিত শান্তির অন্যতম কেন্দ্র যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে আবার উত্তেজনা বেড়ে চলেছে।’
জর্দানের স্কাউট ছাত্ররা শানাইয়ের মতো বাদ্যযন্ত্র ব্যাগপাইপ বাজিয়ে আবার আসা তীর্থযাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছেন ও তাদের বিনোদন প্রদান করেছেন। তাদের সঙ্গে এসেছেন অনেক পর্যটকও।
ধর্মনিষ্ঠ খ্রিস্টানদের বিশ্বাস হলো, ‘জন দ্য ব্যাপটিস্ট এই স্থানেই যিশুকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষাপ্রদান করেছেন। তাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট জানায়, যিশুকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষাদানের এই উৎসবটি এখানে জর্দান নদীটির পূর্ব তীরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জায়গাটি ‘বেথানি’ নামে বিখ্যাত।
আজকের জদানের বহুদূরে ছিল। আরবিতে এই জায়গাটি আছে ‘আল-মুঘাটস নামে’। খ্রিস্টানদের প্রধান তিনজন ধর্মযাজক ‘সেন্ট জন পল-২’, ‘পোপ এমিরেটাস ষোড়শ বেনেডিক্ট’ ও বতমান ‘পোপ ফ্রান্সিস’ তাদের পোপের দায়িত্বভারে এই অন্যতম প্রধান ধর্মীয় তীর্থস্থানে তীর্থযাত্রী হিসেব অংশগ্রহণ করেছেন ও ধর্মীয়ভাবে বিশুদ্ধ হয়েছেন ও অসংখ্য মানুষকে ধমীয় দীক্ষা প্রদান করেছেন। দ্য ক্যাথলিক ল্যাটিন প্যাট্রিআচ অব জেরুসালেমও যিশুর ব্যাপ্টিজনের স্থানের মতো ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
জর্ডান’স ব্যাপ্টিজম সাইট কমিশনের মহাপরিচালক রুস্তম মুখজাইন এই পবিত্র ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন তীর্থকেন্দ্রের গুরুত্ব জানিয়েছেন, ‘যিশু খ্রিস্টের ব্যাপ্টিজমের তীর্থকেন্দ্রটি একটি বিশ্বের উত্তরাধিকার সংরক্ষণ কেন্দ্র বা ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এই তীর্থকেন্দ্র ধর্মের পাশাপাশি মানবতাকে উপস্থাপন, ধারণ, প্রচার ও প্রসার করে। আমরা জর্দানিরা যার জিম্মাদার।
বিশেষ যত্ন ও হাশেমি পরিবারটির জিম্মাদারি ছাড়া, এই পরিবার উত্তরাধিকার সূত্রে জর্দানের শাসক গোষ্ঠী, তাদের বতমান প্রধান মহামান্য রাজা আবদুল্লাহ-২’র আনুকূল্য ও নেতৃত্বদান বাদে কখনো আমাদের এই অর্জন সম্ভব হতো না। তাদের পরিবারের ভালোবাসা এবং আগ্রহ বাদে কখনো আমরা এই তীর্থস্থানটিকে রক্ষাও করতে পারতাম না। আমাদের কাছে সাম্প্রতিক কালে মানবেতিহাসের এই অনন্য অর্জনটিও আসতো না। আমরা এই তীর্থকেন্দ্রের উন্নয়ন ও প্রদর্শনের স্বক্ষমতা বাড়িয়েছি। বিশ্বের যেকোনো মানুষ এখন প্রভু যিশুর খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষাদানের কেন্দ্রটি দেখতে, ঘুরতে ও প্রার্থনা করতে আসতে পারেন। জন ও যিশুর হেঁটে যাওয়া পথগুলোতে পবিত্র হতে পারেন।’
জন হলেন ‘জন দ্যা ব্যাপটিস্ট’ নামে ধর্মে বর্ণিত মানুষটি হলেন খ্রিস্টানদের। মুসলমানদের ইয়াহিয়া নামের নবী। খ্রিস্টান ধর্মে অধ্যুষিত দেশগুলোতে এবং অন্যান্য দেশে বসবাসকারী খ্রিস্টানদের কাছে জর্দান নদীর ধারে বাস করা এই নবীর বাসস্থানটি ‘দ্য সাইট অব যিশু’জ ব্যাপ্টিজম বাই জন দ্য ব্যাপটিস্ট’ হিসেবে বিখ্যাত। ‘দ্য সাইট অব জন দ্য ব্যাপটিস্ট’ নামে খ্যাত তার আবাস।
তবে তাদের আশেপাশে বছরের পর বছর, শতকের পর শতক ধরে-রোমান ও বাইজেনটাইন গির্জাগুলো, একটি মনাস্ট্রি বা খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের বাসস্থান, হামিট নামের গুহাগুলো যেগুলোতে তারা নির্জনে বাস বা তপস্যা করতেন, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদানের বিখ্যাত কেন্দ্রগুলো বা সিঞ্চনের বারি গ্রহণের স্থানগুলো সবই একের পর এক ভূমিকম্পের পর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। নানা মনুষ্যসৃষ্ট সংকটও আঘাত হেনেছে। বানের পানিতে ডুবেছে। ফলে যিশুর দীক্ষাদানের প্রধান এই কেন্দ্রস্থলটিই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে।
জর্দান ও ইসরাইল আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে স্থাপিত ভূমি মাইনগুলো অপসারণ করার পর ২৫ বছর আগে এই পবিত্রতম তীর্থকেন্দ্রটিকে প্রত্নত্বিক আবিষ্কার ও খননের মাধ্যমে আবার ফিরে পাওয়ার কাজ শুরু হলো। এখন ‘দ্য ক্যাথলিক ল্যাটিন প্যাট্রিআর্চ অব জেরুসালেম’ও আবার তার ধর্মীয় এবং আনুষ্ঠানিক গৌরব ফিরে পেয়েছে।
এখন জর্দান পাশের এলাকাগুলোর উন্নয়ন করতে চায় তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের আরও সেবা দান করতে এবং আরও আর্থিকভাবে সঙ্গতিময় হতে। ধর্মীয় কল্যাণের মধ্যে দেশটি তাদের প্রয়োজন অনুসারে থাকার ব্যবস্থা করতে কাজ করতে চায়। তবে সেজন্য প্রচুর তহবিলের প্রয়োজন রয়েছে।
১০৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য ক্যাথলিক ল্যাটিন প্যাট্রিআর্চ অব জেরুসালেম’র আর্চবিশপ ও খ্রিস্টানদের পক্ষে কেন্দ্রটির পরিচালক ফাদার পিয়ার বাতিস্তা পিজ্জাবালা বলেছেন, ‘প্রভু যিশুর খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদানের ধর্মীয় এই স্থানটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির খোঁজে প্রেরণা প্রদান করতে পারে ও অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা এখানে বিভক্তি সবাইকে আলাদা করে দিয়েছে।’
আর্চবিশপ ফাদার পিয়ার বাতিস্তা পিজ্জাবালা আরও বলেছেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এই মধ্যপ্রাচ্যের সবখানে আমরা শত, শত উত্তেজনা, বিভক্তি, বাধা, রক্তপাত, আহত মানুষকে দেখেছি; যেভানে আমরা ভাবছি, আমাদের সকলের ও সব ধর্মের ভবিষ্যত বৈচিত্র্যতা ও ঐক্যবদ্ধতায় নিহিত রয়েছে।’
আর্চবিশপ পিয়ার বাতিস্তা পিজ্জাবালা জানিয়েছেন, ‘আমাদের আশা হলো, এই পবিত্র স্থানটি সেই শান্তির একটি ছোট্ট উদাহরণ হতে পারে। যদি আমরা চাই, এখানে তা সম্ভব।’
জর্দানের আগত একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বাসেল ইসতারা বলেছেন, ‘প্রার্থনা ও দীক্ষাগ্রহণের এই বিশেষ ও পবিত্র জায়গাটিতে বিশ্বের সকলে খ্রিস্টানদের পাশাপাশি আসবেন-আমরা তাদের স্বাগত জানাবো ও ভালোবাসব-এই কামনা রইল।’
ওএফএস/