ভারতের ক্রিকেট ও লতা এবং শচীন
কিংবদন্তী গায়িকা লতা মঙ্গেশকর জীবনের শেষ নি:শ্বাস নিলেন। ভারতীয় হিন্দি সিনেমাও তার জীবন প্রদীপের জন্য ব্যাকুল। কয়েক সপ্তাহ-শেষ দিনগুলোতে তিনি হাসপাতালে ছিলেন। সবার জানা এই তথ্যটি যে, ঝানু, বহুদশী ও প্রবীণ এই গায়িকা ৩০ হাজারের বেশি গান গাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আঞ্চলিক ও হিন্দি ভাষায়। তবে সবার দাবী মেটানো লতা মঙ্গেশকরের আগ্রহ কোন দিকে ছিল?
অল্পই জানা সম্ভব হয়েছে। এটি সবার জানা, কিংবদন্তীটি ক্রিকেটের পাঁড়ভক্ত ছিলেন। ভারতের জাতীয় দলটির সবচেয়ে বড় ভক্তদের একজন টানা ২৮ দিন জীবন যুদ্ধ করে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে রোববার ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সালের সকাল ৮টা ১২ মিনিটে চলে গেলেন। লতার নিউমোনিয়ার উপসর্গ ছিল। অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন চির তরুণী কন্ঠশিল্পী। চলে যাবার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তিনি তার ক্রিকেট ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের ট্রফি জয়ে টুইটারে লিখে অভিনন্দনও জানাতেন। লতা মঙ্গেশকর তার পক্ষে ভারতের ক্রিকেটের জন্য যতটুকু সম্ভব করেছেন।
ক্রিকেটের প্রতি তার এই ভালোবাসা কয়েক দশক আগে থেকে, যখন দেশটি ক্রিকেটে কোনো সুপারপাওয়ার হয়েও ওঠেনি। তিনি টিম ইন্ডিয়ার ১৯৮৩ সালের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের উদযাপনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছেন। হিন্দুস্তান টাইমস নামের দেশের বিখ্যাত সংবাদমাধ্যমকে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি লর্ডস ক্রিকেট মাঠে ফাইনাল খেলাটি দেখেছি। বিশ্বাসই করতে পারিনি যে দুই বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ক্রিকেটের একমাত্র পরাশক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বকাপটি জয় করেছি আমরা। একজন ভারতীয় হিসেবে স্বাভাবিকভাবে এই অজনে খুবই গবিত হয়েছি।’
কপিলের অসাধারণ পারফরমেন্স ও লড়াকু মানসিকতা দলটিকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছে সবার যৌথ অভিযানে। ১৯৮৩ সালের শেষ ম্যাচের জয়টি লাভের পর, লন্ডনে চলে যাওয়া ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদশী হয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। ঐতিহাসিক বিজয়ের জন্য দলের সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানাতে তিনি চলে গিয়েছিলেন তাদের ড্রেসিং রুমে। সেখানে কী ঘটছে সেটিও বিলক্ষণ মনে আছে ক্রিকেট পাগল এই নারীর, ‘আমার মনে পড়ে, আমাদের দলটি সবাই আমার সঙ্গে আমার ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের লেখা একটি গান গেয়েছেন। প্রখ্যাত ভারতীয় ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার ও দলনেতা কপিল দেব আমার পাশে দাঁড়িয়ে গেয়েছেন’-লিখেছে দৈনিকটি।
কপিল দেব ও তার দল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট পরাশক্তি দুইবারের পর, পর অপরাজেয় চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ফাইনালে হারানোর পর বিসিসিআই (বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া) ক্রিকেটের সুবিধা বাড়াতে ও দলটিকে সম্মানিত করতে চাইলো। তবে দলকে সস্মানিত করার সামর্থ্যও তাদের নেই। নগদ টাকার অভাবে ভুগে ধুঁকে, ধুকে এগুচ্ছিলেন তারা। এই জয় তাদেরও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় বোর্ডের প্রশাসক রাজ সিং দুঙ্গারপুর লতা মঙ্গেশকরের কাছে সাহায্যের প্রত্যাশায় হাজির হলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এনকেপি সালভে (নরেন্দ্র কুমার প্রাসাদ রাও-ভারতীয় কংগ্রেসের এমপি) তখন বিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট। তিনি দুঙ্গারপুরের আত্মজীবনীতে প্রথম বলেছেন, ‘আমার কাছে রাজ সিং একটি মেধাবী পরিকল্পনা নিয়ে এলো, যেহেতু তখনকার দিনগুলোতে আমাদের হাতে যথেষ্ট টাকা ছিল না। সে লতা মুঙ্গেশকরকে দিল্লীতে একটি গানের অনুষ্ঠান করতে অনুরোধ জানাবে, যাতে ক্রিকেটের ভবিষ্যতের টাকাগুলো ওঠে।’
হিন্দুস্তান টাইমসকে এই প্রখ্যাত গায়িকা একটি সাক্ষাৎকারে পরে জানিয়েছেন, ‘আমি শুনে বলেছিলাম, অবশ্যই আমি কাজটি করবো। ১৭ আগষ্ট এজন্য মুম্বাই থেকে দিল্লি চলে গেলাম। একটি বিশেষ শো আমি তাদের জন্য করেছি। সুরেশ ওয়াদেকার (বলিউড ও মারাঠি সিনেমার প্লেব্যাক গায়ক) ও নিতীন মুকেশ (বলিউডের প্লেব্যাক গায়ক) শোটিকে সাহায্য করেছে। এখানে রাজিব গান্ধিও উপস্থিত ছিলেন।’ কনসার্টের জন্য, লতার কণ্ঠের সুধায় মিশতে একটি গানের গীত রচনা করেছিলেন তার ভাই পন্ডিত হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। প্রথম কলি-‘ভারত বিশ্ব বিজেতা।’ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সব সদস্য স্টেজে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে গানটি গেয়েছেন। লতা মঙ্গেশকরের বিশেষ কনসার্টটি থেকে ২০ লাখ টাকা ক্রিকেটের উন্নয়নে বিসিসিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মেলোডি কুইন। ১৯৮৩ সালে এই অথ রাজার ঘরেও ছিল না। একটি টাকাও কনসার্ট থেকে নেননি অবিম্মরণীয় সঙ্গীত প্রতিভা।
গানের বহুমুখী প্রতিভাটি অনেক ধরণের গানে পারঙ্গম-গায়িকাটি অনেক উপলক্ষে তারপরও ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন। ক্রিকেটের প্রতি তার প্রবল ভালোবাসায় এমন অনেক ঘটনা আছে, যখন প্রবল ব্যস্ততায়ও তিনি ক্ষুধার্তের মতো অন্তত ম্যাচের স্কোরটি জানার জন্য চেষ্টা করেছেন। বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম বিবিসি হিন্দিকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের এই দলের সব খেলোয়াড়ই ভালো। তবে আমার প্রিয় শচীন।’ এই বলে তিনি ক্রিকেট নিয়ে তার জ্ঞানের জাহিরও করেছেন-‘সুনীল গাভাস্কার পারফেক্ট বা নিঁখুত হিসেবে শ্রদ্ধার পাত্র, সেই দলটিতে অতিরিক্ত শক্তি হলেন কপিল দেব। আমার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায়টি হলো বেছে নেবার-আমাদের দেশের সব ক্রিকেটটারই ভালো, তালিকার নীচের দিকেররাও ভালো। আমি সবাইকে ভালো বলবো। এই হিসেবে দ্রাবিড় (রাহুল দ্রাবিড়)কেও ভালো বলতে হয় (হাসি)। সম্ভবত আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো শচীন। এই বিষয়ে সামান্যই প্রশ্নের অবকাশ আছে। সবাই তাকে ভালোবাসে। তাহলে আমি কেন পিছিয়ে থাকবো?’
মাস্টার ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারের প্রতি তার অনুরাগ ও ভালোবাসার কথা অনেকবার জানিয়েছেন। লতাজির শচীনের সঙ্গে একটি শক্ত বন্ধন ছিল। ক্রিকেটের মাস্টার ব্লাস্টারও তাকে খেলাটির বাইরে পূজা করে গিয়েছেন শেষতক। ভারতীয় সঙ্গীতের এই মহাতারকা যখন শচীন ভালো ব্যাটিং করতেন ও খেলতেন; তার তীব্র উত্তেজনা ও খুশি লুকিয়ে রাখতে পারেননি। মাস্টার ক্রিকেটারের সঙ্গে তার সম্পকও ছিল খুব ভালো। একেবারে মা-সন্তানের মতো। একটি উদাহরণ-২০১৪ সালে ভারতের মুম্বাইতে কিংবদন্তী গায়িকার ৮৫তম জন্মদিনের আয়োজন করা হলো। ২৮ সেপ্টেম্বরের দিনটিতে ক্রিকেট ওস্তাদ শচীন টেন্ডুলকার অভিনন্দন জানিয়েছেন, সে আসরে তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন। গানের অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক প্রতিষ্ঠান হৃদয়েশ আটস সম্মুখানন্দ অডিটোরিয়ামে, মুম্বাই শহরের প্রাণকেন্দ্রের পাশের কিংস সার্কেল নামের একটি রেলওয়ে স্টেশনের ধারে লতাজির জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানটি করেছে।
ক্রিকেটের অন্যতম তারকা বাদে প্রখ্যাত ভারতীয় গানের অন্যতম তারকা লতার ছোটবোন আশা ভোঁসলে সেই জন্মদিনের বিশেষ অতিথি ছিলেন। আরো ছিলেন বলিউড ও ভারতীয় গানের অনেকে। তাতে ‘মেরা ভাইজানস’ নামে তার বিখ্যাত গানটি নিজে গেয়ে শুনিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। গানটি লিখেছেন তার ছোটভাই পন্ডিত হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। অনুষ্ঠানটি লতার বিশেষ কিছু ছিল। কেননা, গানের পেশাজীবনের ৬০ বছর উদযাপন করেছেন সেদিন। পেশাজীবনে তার বোন-তাদের পরিবারের প্রধান আলো লতা মঙ্গেশকর মোট ৩৬টি ভাষায় ১ হাজারের বেশি সিনেমার গান রেকড করার গৌরবেন অধিকারী তখনই। তিনি সেদিন ক্লাসিক্যাল থেকে রোমান্টিক; গজল সবই গেয়েছেন। তার চিরকালের মিষ্টি গান-‘আজা রে পরদেশী’, ‘কাহি দীপ জ্বালে কাহি দিল’, ‘বেটি না বেটাই রাইনা’, ‘তেরে বিনা জিন্দেহি সে’, ‘তেরে বিনা জিয়া জায়ে না’, ‘নেইনো মে বাদরা’, ‘চলতে চলতে’ ও ‘ইয়ারা সিলি সিলি’র মতো গানগুলো মনের দরজা খুলে গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর।
২০১৩ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বিস্ময়, তার মতোই যে একেবারে ছোট্ট বয়সে ক্রিকেট মাঠে প্রতিভা ছড়াতে শুরু করলেন; তিনি অবসর নেবার ঘোষণা দেবার পর বহু ধরণের গানের এই মহাতারকা তার দুঃখের কথা জানাতে ভোলেননি-‘আমি আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না সে অবসর নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানার পর কেমন লেগেছে। বলতে গেলে, আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে, তীব্র কষ্ট পেয়েছি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও এই ব্যথা ভুলেছি। মনকে বলেছি, কেউই সারাজীবন বা চিরকাল কাজ করতে পারে না। এমনকি একজন মহাতারকা-তাও শচীন টেন্ডুলকারের মানের, সেও পারে না। আমি ভেবেছিলাম আরো কিছুদিন ভালোভাবে সে ক্রিকেট খেলে যেতে পারতো, তবে এটি একেবারেই তার সিদ্ধান্ত। যদি সে মনে করে এটিই সবচেয়ে ভালো সময় আনুষ্ঠানিকভাবে চলে যাবে, তাহলে আগেরগুলোর মতো তার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। তার সঙ্গে আমি এগিয়ে চলি। তবে হ্যাঁ আমার ভীষণ কষ্ট লাগে, যখন ভাবি আর কোনোদিন আমাদের চোখের সামনে ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামবে না শচীন টেন্ডুলকার।’
ছবি : ১. ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর।
২. মাস্টার ক্রিকেটার শচীনের সঙ্গে গানের পাখি।
(ইকনোমিক টাইমস ও অন্য ভারতীয় ওয়েবসাইটের ইংরেজি লেখা থেকে)