আলোকিত নারীর ভুবনে অ্যাঞ্জেলা গোমেজ
র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়াডজয়ী ও বেগম রোকেয়া পদক বিজয়ী অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। এখন লাখ, লাখ বাংলাদেশী ও বিশ্বের নারীর জীবনের আলোর প্রতীক হয়েছেন তিনি। যে জীবনগুলাতে বদলে দেবার জন্য হাত দিয়েছেন, তাদের জীবনে সোনা ফলেছে।
জন্মেছেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ১৯৫২ সলের ১৬ জুলাই। ঢাকা বিভাগের একটি জেলা গাজীপুরে। তিনি তার চার ভাই ও পাঁচ বোনের চতুর্থ। একেবারে অপ্রাপ্ত বয়সে বাবা, মায়ের বাল্যবিবাহ দেওয়া ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি নিজের। এরপর গৃহচ্যুত হয়েছেন ও তারও আগে একটি শোভন শিক্ষাব্যবস্থায় চলে যেতে স্বক্ষম হয়েছেন। খ্রিস্টান এই মেয়েটি সেই যশোরের সিস্টারস অব চ্যারিটির একটি শিক্ষাবৃত্তি যোগাড় করতে পেরেছেন তাদের সম্প্রদায়গত মাধ্যমে ও তাদের ছাত্রীনিবাসে নিজের পড়ালেখা এবং জীবনযাপনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছেন। এভাবেই ভিন্ন একটি জীবনের দিকে ভাগ্য ও অশিক্ষা, পরিবারের বঞ্চনা অ্যাঞ্জেলা গোমেজকে ঠেলে দিয়েছে। সেখানে তিনি সেইক্রেড হার্ট স্কুলে পড়তেন। এখানেই গভীরভাবে ফাদার সেসির জীবনদর্শনে অনুরক্ত হয়ে পড়লেন অ্যাঞ্জেলা। তিনি একজন জিভেরিয়ান ধর্মযাজক, যার কাজের ভুবনটি ছিল যশোরের মেথর, মুচিদের বস্তিগুলোতে। জীবনের এই পর্বে অ্যাঞ্জেলা নিজের চোখে আরো বিশ্বাস করলেন যে, বাংলাদেশের নারীদের জীবন নির্বাসিত হয়েছে। ‘১৩ বছর বয়সে আমি নানদের সঙ্গে পড়ালেখার কালে, পরিস্কারভাবে দেখলাম যে, মানুষের লিঙ্গগত পার্থক্য রয়েছে, সেটি প্রবলতম, বিশেষভাবে একেবারেই গরীব মেয়েদের অবস্থা সবচেয়ে প্রতিকূল। এভাবে ধীরে ধীরে আমার উপলব্ধি হলো, মেয়েরা ঘৃণিত, তারা সবধরনের নির্যাতনের শিকার ও তাদের সকল ধরনের মানবাধিকার লংঘিত ও অনেকগুলোই অনুপস্থিত। ফলে আমি তাদের জন্য কিছু করতে চাইতাম। দেখতে, দেখতে আমার বিধবা, বিবাহ বিচ্ছেদ প্রাপ্ত ও স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়েদের জন্য কাজ করতে হবে মনে হয়েছে’ মনে পড়ে তার।
তবে একা, একা কষ্ট করে পড়ালেখা করা অ্যাঞ্জেলা গোমেজ তার পড়ালেখার ভুবনটিকে বিদায় করেননি, সম্পন্ন করতে চেয়েছেন সবসময় সবচেয়ে ভালোভাবে। ফলে ১৯৭৫ সালে তিনি বিএ পাশ করলেন ও এরপর থেকে তিনি তার জীবনকে নিয়ে গেলেন সেই নারীদের নিয়ে কাজ করতে। কাজ শুরু করলেন গ্রামে। তবে সকল ধরনের সমস্যারই মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। নিজের জীবনের সকল ধরনের বাধার মোকাবেলা সাফল্যজনকভাবে করতে পারা অ্যাঞ্জেলা গোমেজ একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সেই পরামর্শটি গ্রহণ করলেন একা, একা মেয়েদের জন্য কাজ করার চেয়ে তিনি নিজেকে ও তাদের বাঁচাতে পারবেন একটি সংগঠন গড়ে। ফলে ১৯৮১ সালে অ্যাঞ্জেলাতে হাতে বীজ রোপিত হলো বাঁচতে শেখা’, তার প্রতিষ্ঠান, আজীবনের স্বপ্ন।
‘শুরুর দিনগুলোতে নারীরাই আমাকে বিশ্বাস করতে পারতেন না যেহেতু আমি একটি খ্রিস্টান মেয়ে। তারা ভাবতেন ও ভাবভঙ্গিতে জানাতেন, আমি তাদের ধর্মটিও বদল করতে এসেছি। তাদের খ্রিস্টান বানাতে কাজ করছি। আবার এমন অনেক বছর কেটেছে যেখানে নারীরা আমার চেহারা দেখলেই সরে যেতেন, তাদের কাছে বিপদ এসেছে, এই মেয়েটি অপয়া কেননা তার কোনো সন্তানই নেই। তারপরও আমি এগিয়ে যেতাম ও তাদের সমস্যাগুলো জানার জন্য আলোচনা করার চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। পরে তারা আমাকে জানাতেন, কেবল সন্তান ছাড়া তার আর বাকি সব ধরনের সমস্যাগুলোতেই আক্রান্ত, আমি তাদের প্রেরণা ও সহযোগিতা করতাম’ বলেছেন তিনি। গ্রামের মানুষদের জন্য, মানুষের জীবনমান বদলাতে একেবারেই মুসলিম নারীদের পোষাক পরে আজীবনের অত্যন্ত শালীন পরিবেশে ও পোষাকে জীবনযাপন শুরু থেকেই করে চলেছেন বাঁচতে শেখার নির্বাহী প্রধান। দীর্ঘকাল তার কোনো নিজেকে সহযোগিতা করতে সহযোগী নেননি, তার প্রতিষ্ঠানেও কর্মীর সংকট ছিল। কাজেরও। তারপরও অ্যাঞ্জেলা গোমেজ নামের নিজেকে বাঁচাতে শেখা নারীটি একা, একাই গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছেন, তার বাঁচতে শেখা’কে ছড়িয়ে দিয়েছেন ও মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটেছেন। এখনো তাই করেন তিনি। তবে তখন এই কাজগুলো মোটেও সহজ ছিল না। প্রতিহিংসাপরায়ণ ও গ্রাম্যনেতাদের ও তাদের গ্রামবাসী পুরুষদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য অনেক কাঠ, খড় পোড়াতে হয়েছে অ্যাঞ্জেলাকে।
যখন তিনি রেশমগুটির চাষের মাধ্যমে রেশমী কাপড়ের বুনন প্রকল্প শুরু করলেন, আরো অনেক সহযোগী নারীদের সঙ্গে টানা ২২টি দিন এই নারীদের বাড়িতে থেকেই যশোরের একটি স্থানের রেলস্টেশনের দুই পাশের ঝোপঝাড়ে তাকে চারাগুলো রোপন করতে হয়েছে। এরপর দেখাশোনাও করেছেন। তবে যে পুরুষরা মেয়েরা নিজেদের এক করছেন ও তারা বাড়ির বাইরে এসে কাজ করছেন ও বেগানা হচ্ছেন সহ্য করতে পারেননি, তাদের সঙ্গে আবার অ্যাঞ্জেলা আছেন, তারা তাদের সবগুলো শ্রমকে ব্যর্থ করে দিলেন সেগুলোর মূলোৎপাটনের মাধ্যমে।
অ্যাঞ্জেলাকে মুসলিম মেয়েদের খ্রিস্টানে রূপান্তরের সংকটগুলোকে মোকাবেলা ও অভিযুক্ত হতে হয়েছে। তিনি তার সংগঠনকে খ্রিস্টান দিয়ে কেন ভরিয়ে ফেলছেন যেটিকে তিনি খন্ডন করেছেন সামান্য কয়েকজন খ্রিস্টানই আছেন তার বাঁচতে শেখায়। এছাড়াও অ্যাঞ্জেলার নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে তার নিজের প্রতিষ্ঠানের অংশ হতে বাঁচতে শেখার নামে আর্থিক অনিয়মের মামলাই দায়ের করেছেন। সেটির মোকাবেলা তো করতেই হয়েছে, দাতাদের মাধ্যমেই তাদের পূর্ণ কমিটিতেই বিশেষ অডিট করতে হয়েছে তাকে। যারা অবশেষে নিজেরা এবং আদালতও জানিয়েছেন এবং সবাই একবাক্যে সারা দেশে স্বীকার করেন যে, ‘বাঁচতে শেখা হলো অসাধারণ, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও পুরোপুরিভাবে একটি আন্তজাতিক মানে পরিচালিত এনজিও।’
অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ও তার বাঁচতে শেখা বাংলাদেশের গ্রামের লাখ, লাখ নারীদের জীবনমান বদলে দেওয়া এবং পরিবারগুলোকে উন্নত করা একটি অসাধারণ প্রতিষ্ঠান। যে নারীদের বেঁচে থাকার জন্য খাবার, তাদের পরিবারগুলোরও, কাজ, শিক্ষা ও অধিকারগুলো প্রদান করেছে বাঁচতে শেখা। তাদের যে ১.৫ হেক্টর জমিতে প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স আছে, সেখানে অনায়াসেই একত্রে ২শ মানুষ থাকতে পারেন। সেখানে তাদের নারীদের আশ্রয়স্থলও গড়েছেন তারা। বাঁচতে শেখার ২৫ হাজার নারী সদস্য রয়েছেন, যারা ৭৫০টি গ্রামে থাকেন এবং এই গ্রামগুলোতেই জালের মতো ছড়িয়ে আছেন তারা। অ্যাঞ্জেলার ধারণা, অন্তত ২ লাখ মানুষ তাদের গ্রামীণ জীবনে বাঁচতে শেখার মাধ্যমে উপকারভোগী হয়েছেন।
আয়বর্ধক অনেকগুলো প্রকল্প দিনে, দিনে চালু করেছে তাদের বাঁচতে শেখা। সেগুলোর মধ্যে আছে টেকসই কৃষিকাজ, টেকসই খামার ব্যবস্থাপনা, গবাদিপশুর ফার্ম, হস্তশিল্প, রেশমগুটি এবং মাছের চাষ। মাতৃকালীন স্বাস্থ্য, নারীর স্বাস্থ্যযতœ, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র, সঠিক খাবার পানি লাভ, সুষ্ঠু পয়নিষ্কাষণ ব্যবস্থা, মেয়ে ও শিশুদের স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম, গর্ভকালীন সহযোগিতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপক্ষে শিক্ষা, প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা, মৌলিক অধিকারগুলো প্রদান, বয়স্ক ও অসহায় নারীদের খাবার, পোষাক ও চিকিৎসা, নারী ও শিশু সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প, মেয়েদের মাসিক কার্যক্রম ও সুস্থ এবং নিরাপদ থাকার শিক্ষা কাযক্রম আছে তার। এছাড়াও গ্রামের মেয়ে ও নারীদের সমাজিক ও মানবাধিকারের অধিকারগুলো নিয়ে প্রকল্প ও কার্যক্রম পরিচালনা করে অ্যাঞ্জেলা গোমেজের বাঁচতে শেখা। তারা সুশাসনের জন্যও সামাজিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। সামাজিক অধিকার শিক্ষা কার্যক্রম আছে। সেখানেও তারা লিঙ্গগত সমঅধিকারের বিষয়ে পাঠদান করেন। মেয়েদের গৃহ সুরক্ষা ও আইনগত অধিকারগুলো প্রদান করেন। শিশু নির্যাতন ও পাচার এবং তাদের শিশুশ্রমে বাধ্য করার বিপক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করেন, শিক্ষা সহায়তা দেন। তাদের সবার জন্য নানা ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন আছে বছরভর। তাদের বাঁচতে শেখার একটি আইনি সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে। যেসব নারীদের আইনী সাহায্য ও পরামর্শ প্রয়োজন, তাদের জীবন, সম্পত্তি ও পরিবারে বাঁচতে শেখা প্রদান করে। এই নারীদের আইনী সহায়তা কেন্দ্রটিই হলো বাংলাদেশের নারীদের মাধ্যমেই পরিচালিত একমাত্র সহায়তাদান। এই পর্যন্ত সাড়ে ৩শ গ্রামের নারীকে আইনী প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারা কর্মশালাগুলোতে।
একটি শক্তির উৎস
শুরুর দিনগুলোতে অ্যাঞ্জেলা গোমেজ একটি ধার করা বাইসাইকেল বের করে একা, একাই প্যাডেল মেরে তার জন্মস্থান বাংলাদেশের যশোর জেলার ধুলি, মলিন বিবর্ণ রাস্তাগুলোতে পৌঁছাতেন। তিনি গ্রামে, গ্রামে ঘুরে গরীব নারী ও মেয়েদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। তাদের জীবনের সমস্যা ও সংকটগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন মেয়েটি। এরপর যে সামান্য সাহায্যই তিনি করতে পারতেন, সেগুলো খুব ভালোবাসা নিয়ে নিতে অনুরোধ করতেন। তিনি তাদের জীবনের ঐতিহ্য অনুসারে এই সমস্যাগুলোতে হস্তক্ষেপ করতেন। আবার অনেকসময় এই পরিবার ও বিভিন্ন সমাজের কর্তারা তার এই কাজগুলোতে প্রবলভাবে বাধা প্রদান করতেন। তবে কোনোকিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। ‘পিং পং বলের মতোই আমাদের দেশের নারীদের নিক্ষেপ করা হতো’ বলেছেন তিনি। আর তাদের জন্যই উৎসর্গিত প্রাণ অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। নিজের কথা বলেছেন, ‘যেসব উৎপীড়ন ও নিদয় ব্যবহারগুলোর শিকার আমি হয়েছি, যেসব বাজে কথা ও অপমান এবং অমর্যাদার শিকার আমি আমার জীবনে হয়েছি, সেই নারীদের ভালোবাসায় সেগুলোই আমাকে আমার লক্ষ্যকে অর্জনের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছে ও সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে।’ এভাবেই তার জীবনের আরো ২০টি বছর কেটেছে। এখন অ্যাঞ্জেলার বয়স ৪৭ (যখন তিনি পুরস্কারটি লাভ করেন)। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ও বৃহৎ নারীদের গ্রামীণ বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওটি-‘বাঁচতে শেখা’ পরিচালনা করেন। তার প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর যশোর জেলায়। এখানেই থাকেন। যেখানে গড়ে তুলেছেন ১.৫ হেক্টর জমির ওপর প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স। তার প্রতিষ্ঠানটি ৪শ ৩০টি গ্রামের ২৫ হাজারের বেশির নারীদের স্বাবলম্বী করতে নানা ধরনের প্রকল্প ও কর্মশালা পরিচালনা করে। তাদের কার্যক্রমগুলোর মাধ্যমে আনুমানিকভাবে ২ লাখ মানুষ সুবিধাভোগী হচ্ছেন।
১৯৭৬ সালে নিজের হাতে তিলে তিলে বাঁচতে শেখার শুরু করেছেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। এখনো হাল ধরে আছেন। বিপুল পরিমাণ গ্রামীণ নারীকে নানা ধরনের বৃত্তিমূলক ও জীবনমুখী এবং আয়বর্ধক কার্যক্রমে নিয়োজিত করেছেন তিনি। তারা তাদের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিতে বিপুল পরিমাণ হস্তশিল্প, ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু, মাছের চাষ, মৌমাছি পালন ও সিল্কের শাড়িকাপড় তৈরি করছেন। এজন্য তারা সিল্কের প্রয়োজনীয় রেশম গুটিসহ তাদের জীবনের এই কাজগুলোর সবই উৎপাদনেও গিয়েছেন। এছাড়াও তাদের এবং পরিবারগুলোর শিশুদের জন্য বিরাট একটি স্বাস্থ্যসেবা কাযক্রম পরিচালনা করে চলেছে বাঁচতে শেখা। তাদের নানা ধরনের উন্নতির দিকে নিয়ে চলেছেন তারা। গর্ভ ও মাতৃকালীন সেবা, নারীদের বিরাট আকারের মৌলিক শিখন দক্ষতাগুলো প্রদান করেন। তাদের নারী ও বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে।
নিজেদের জন্য তারা আয় করতে কাজ করেন। বাঁচতে শেখা নিজস্ব ও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সাহায্য লাভ করেন। বাঁচতে শেখা গ্রামীণ ক্রেডিট প্রগ্রাম পরিচালনা করে। তাদেরকে জীবনের ও পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও সকল ধরনের ঋণ প্রদান করে। এমনকি জরুরী প্রয়োজনের সময় নগদ সাহায্য করেন তারা। বাঁচতে শেখা এখন পুরুষদের নিয়েও কাজ করে। নারীদের সকল ধরনের আইনী সাহায্য প্রদান করে। এজন্য মুসলিম আইন ও প্রয়োজনীয় ভূমি আইনী সাহায্যও প্রায় বিনামূল্যে প্রদান করেন কর্মীরা। গ্রামের নারীদের গৃহ নির্যাতনের প্রবল হারের বিপক্ষেও যুদ্ধ করে চলেছেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ও তার সহযোগীরা। যশোরের কিছু গ্রামে প্রবল যৌন নিযাতনের বিষয়াদি, তাদের বিয়ের সময় যৌতুক প্রদান, গৃহ থেকে মেরে তাড়িয়ে দেওয়া, শিশুদের নানাভাবে ভুল উপায়ে বড় করা, লিঙ্গগত বৈষম্য একটি সাধারণ পুরুষশাসিত সমাজে খুব ভালোভাবে মোকাবেলা ও উত্তরণ করে চলেছে বাঁচতে শেখা। এমনকি গর্ভপাতের বিপক্ষেও তারা কাজ করে চলেছেন। এজন্য প্রশিক্ষিত সকল ধরনের কর্মীবাহিনী গড়ে তুলেছেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ যশোরেই।
বাংলাদেশে নারীর অধিকারহীনতা সত্যের চেয়ে বাস্তব সত্য এখনো। সংবিধানে কী লেখা আছে, সম্পত্তি আইন কী বলে, পারিবারিক আইনে কী বলা হয়েছে ও মুসলিম পারিবারিক আইনে কী লেখা-এর কোনোটিই বাংলাদেশের নারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানেই কাজ করেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ও তার বাঁচতে শেখা। তাদের এই সমাজটি শুরু থেকেই অতি দরিদ্র নারীতে ভর্তি, যাদের প্রায় সবারই তখন অক্ষরজ্ঞানই ছিল না। বেশিরভাগই পুষ্টিহীন, সন্তানের বেদনায় কাতর ও সংসারের চাপে প্রাণহীন। পুরুষদের কোনো অধিকারই প্রাপ্য নয় তাদের, কোনোকালেই পাওয়া হয় না। একটি গৃহে বন্দী নারীকুলের মধ্যে কাজ করেন তারা।
অ্যাঞ্জেলা গোমেজের পরিবারের মানুষরা বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, সংসার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছেদী। তার হাতেই ছেলেমেয়েদের বড় করার ভারটি, সাংসার দেখাশোনা ও করার। যদি এই ক্ষুদ্র গৃহকোণে সেই নারীদের কোনো একজনকে পরিত্যাগ করেন তার বাবা বা ভাই ও অন্য কোনো স্বজন, তাহলে তার আর কোনো উপায় কখনো থাকে না। তাদের কাউকে নির্যাতনের ঘটনা একেবারেই স্বাভাবিক চিত্র বিপক্ষের অ্যাঞ্জেলার জীবনে। কোনো, কোনো সময় তার নারীদের কেউ, কেউ ধর্ষণের শিকার হন। সবক্ষেত্রেই তিনি সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। নারীদের সকল ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়মিতভাবে সবসময় পুরুষরাই নির্ধারণ করেন। এভাবেই সবকিছু সবসময় চলে আসে। এই লাখ, লাখ নারীরা এই ব্যবস্থাটিই বলবৎ থাকবে বলে নিশ্চিত ও অনুসরণকারীনি। তবে প্রায় শতভাগ মুসলমানের দেশে একটি খ্রিস্টান নারী অ্যাঞ্জেলা গোমেজ জানালেন, কীভাবে বাঁচতে শিখতে হয় ও বেঁচে থাকতে হয়। এই মেয়েটির জীবনও দুঃখে ভরা। যশোরেরই একটি মিশন স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। ছোটকালে একজন নানকে তার গ্রামে কাজ করার সময় সহযোগিনী হিসেবে নিয়মিত যেতেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। মেয়েদের নানা সমস্যার সমাধানে কাজ করতেন তিনি। আর নানাভাবে তার প্রতিবাদগুলো জানাতেন। তখন থেকে প্রতিবাদের একটি ধারালো হাতিয়ার হয়ে গড়ে উঠেছেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। তার ভালো না লাগলে বলতেন। আর তাকে ধৈর্য্য ধরতে অনুরোধ করতেন আরেক নারীটি। এভাবেই ধৈর্য্য, ভালোবাসা ও নারীর প্রতি ভালোবাসার অ্যাঞ্জেলা গোমেজের ভুবনটি গড়ে দিয়েছেন তিনি। অ্যাঞ্জেলার মনে পড়ে, “একবার আমি তার সঙ্গে কথা বলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিলাম ও তাকে বললাম, ‘যদি আপনি কোনো পরিবর্তন আনতে না পারেন, এই নারীদের যদি বাঁচাতে না পারেন, তাহলে কেন তাদের অনুগত থাকার পরামর্শটি দিয়ে চলেছেন? কেন তাদের প্রতিরোধের জন্য আপনি সাহায্য করছেন না?” এরপর ঘটনাপ্রবাহে বিপ্লবী আচরণের দিকে চলে গেলেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ও তার প্রিয় বিদ্যালয় থেকেই তাকে এই কার্যক্রমগুলোর দায়ে বহিস্কার করে পড়ালেখা বন্ধ করে দেবার দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই মেয়েটিই হলেন আজকের ‘বড় আপা’, ‘বাঁচতে শেখা’র মূল কারিগর। অ্যাঞ্জেলা বলেছেন, ‘আমি আর চুলগুলোকে পর্যন্ত নারকেল তেল দিয়ে ভালোভাবে খুব সুন্দর করে আঁচড়ে যেতাম, তারপরও কাজ হয়নি। আমি আবিষ্কার করেছি, আমার এই খ্রিস্টান নামটিও হলো বিরাট আকারের বাধা, ফলে সেটিকে আমি অঞ্জু বানিয়ে ফেললাম, ফলে আরো বেশি মুসলিম মেয়েদের নাম মনে হবে। আমি নিজেকে উপস্থাপন করতে লাগলাম একজন বিবাহিতা মুসলিম নারী হিসেবে, যার স্বামীটি কে-এই বারবার প্রশ্নের জবাবে বলতে হতো, তিনি বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েছেন। একটি ছেলে ও মেয়েকে আমার সন্তান হিসেবে রাখতে শুরু করলাম, যাতে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি।’ কাজ থেকে সরানো যায়নি মেয়েদের বাঁচতে শেখানোর কারিগরকে। তিনি তার স্বর্বস্ব দিয়ে কাজ করতে লাগলেন একেবারেই প্রাথমিক ও সামান্য থেকে এবং ধীরে, ধীরে তিনিও বাঁচতে শিখে গেলেন ও বাঁচাতে লাগলেন অমূল্য জীবনগুলোকে। আস্তে, আস্তে তিনি খোলা মনের আলোচনার দিকে গেলেন ও তাদের সমর্থনগুলো লাভ করতে লাগলেন, যারা তাকে বুঝতে পারেন, তারা পাশে দাঁড়াতে শুরু করলেন। অ্যাঞ্জেলা গোমেজকে বিপুল সংকটের মোকাবেলাও করতে হয়েছে। নিজের ঘরটি ছাড়তে হয়েছে এবং সেই কিছুকালের জন্য তাকে একটি মুসলিম পরিবার তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। অ্যাঞ্জেলার মনে পড়ে, ‘পরিবারের কর্তা স্বামীটি আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি আমার সঙ্গে আমার কাজে যাবেন, যেহেতু আমার কাজ করাই নিষিদ্ধ। তিনি আমাকে সকল ধরনের নিরাপত্তা ও সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিলেন। তার কথা আমার এখনো বারবার মনে পড়ে। তিনি আমার প্রতি যে মহত্ব দেখিয়েছেন সেটি বর্ণনার জন্য আমি কোনো শব্দ খুঁজে পাই না।’
গেল আড়াই বছর ধরে বাঁচতে শেখার বড় আপার ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার। তিনি ক্যান্সারের সঙ্গে তার জীবনের বিনিময়ে যুদ্ধ করে চলেছেন, ‘এই মরণব্যাধি আমাকে ফেলে দিয়েছে ও নতুন ধরনের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে নামিয়ে কাজের ভুবনটিই বদলে দিয়েছে।’ তারপরও বাঁচতে শেখার জন্য গ্রামে, গ্রামে সফর করেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। এছাড়াও নারী ও উন্নয়নকমীদের আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অসুবিধাগুলোর মোকাবেলা করতে হয় তাকে ও আইনী ঝামেলাগুলো পোহাতে হয়। দুঃখ করে বাংলাদেশের বরেণ্য এই এনজিও ব্যক্তিত্ব বলেছেন, ‘আমার গ্রামের নারীদের মতো আমার কার্যক্রমকেও শেষ করে দেওয়ার জন্য অনেক বাধা ও বক্রোক্তি এবং অপবাদ দেওয়া হয়েছে, আমার বিপক্ষে অনেক, অনেক কুৎসা রটানো হয়েছে। ঘটনাপ্রবাহে কোনো, কোনো সময় আমার ডোনেশনগুলোও অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন করে দেওয়া হয়েছে। তবে আমি আমার প্রকল্পগুলোকে মেয়েদের ও কর্মীদের সাহায্যে বন্ধ হতে দেইনি কখনো। এমনও সময় গিয়েছে আমি বাঁচতে শেখার বেতনই সাতটি মাস টানা দিতে পারিনি। অবর্ণনীয় কষ্ট হয়েছে।’
এই অ্যাঞ্জেলা গোমেজকেই ‘কমিউনিটি লিডারশিপ’ বা যৌথ অধিকারগত সামাজিক ক্ষেত্রে ১৯৯৯ সালে এশিয়ার নোবেল ‘দ্যা র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়েছে তার অনন্য কার্যক্রমের স্বীকৃতি হিসেবে। পদক ও পুরস্কারটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ তাদের ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন, ‘অ্যাঞ্জেলা গোমেজ বাঁচতে শেখার নির্বাহী পরিচালক, তার জন্মভূমি বাংলাদেশের নারীদের তাদের লিঙ্গসমতা ও উন্নত জীবনের জন্য অসাধারণ সহযোগিতা আজীবন প্রদান করেছেন। তিনি আইনের অধীনে এবং প্রতিদিনের জীবনেও তাদের সহায় হয়েছেন। তিনি তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হয়েছেন।’ জীবনজয়ী অ্যাঞ্জেলা গোমেজ বলেছেন, ‘এই স্বীকৃতি আমার জন্য অবিশ্বাস্য। আমি কোনোদিনও এমন কোনো পুরস্কার পাবো স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি বিশ্বাস করি, এই স্বীকৃতি ও পুরস্কারটি ঈশ্বরের দান, যিনি নির্যাতিত, নিগৃহীত, পদদলিত, নিপীড়িত, ধর্ষিত, উৎপীড়িত, আক্রান্ত, নিকৃষ্ট, ও তাড়িত নারী সম্প্রদায়ের দায়িত্ব পালন আমার ওপর ন্যস্ত করেছেন।’
(র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ডের সাইট থেকে অনুবাদ)
ডিএসএস/