‘বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে’
মাঘের শেষে ফাল্গুনের প্রথম প্রহরে বাঙালি মেতে উঠে ‘বসন্ত’ উৎসবে। তাতে প্রাণে প্রাণ যোগ করে প্রকৃতি ও মানুষ। সুরে ও ছন্দে আনন্দের রিনিক-ঝিনিক মাদল বাজায় বসন্ত। বসন্তের রঙ হলুদ। তার সঙ্গে লাল ও কমলার নিবিড় বন্ধন। মাঘের শীত ঘুম পাড়িয়ে রাখলেও ফাল্গুনের প্রথম দিনের ভোরে ঘরের বাইরে পা দিলেই বাসন্তী হাওয়া এসে জানিয়ে দিয়ে যায় ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে।’
নওগাঁ শহরের চারপাশে বাসন্তী রঙের ছড়াছড়ি। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বসন্তের রঙে সবাই নিজেকে রাঙিয়ে নেয়। প্রাণে প্রাণে দোলা দেয় নতুন আবেশ। হৃদয়ের ব্যাকুল তন্ত্রিতে তখন আপনিতে বেজে উঠে—আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...।
বসন্ত উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। বর্ষবরণ, নবান্ন উৎসব, পৌষমেলা—এ সবের মতো বসন্ত উৎসবও বাঙালি চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহনশীলতা। দৃঢ়তর হয় মৈত্রীর বন্ধন। শুধু নওগাঁতে নয়, দেশজুড়ে বসন্তের আবাহনে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। প্রকৃতি আর মানুষের এই মিলনমেলা গোটা দেশকে মাতিয়ে তোলে আনন্দ হিল্লোলে। ইথারে ইথারে তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার ঘরে ঘরে।
নওগাঁতে নওগাঁ সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসের সামনে বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা বসন্ত উৎসবে আগত দর্শনার্থীদের কপোলে এঁকে দেবে বসন্তের আল্পনা। যার মাধ্যমে তৈরি হবে অনন্য মেলবন্ধন। শহরের বই পট্টি এলাকায় পসরা সাজিয়ে বসেছেন ফুল বিক্রেতারা। অপরূপ এ দৃশ্য শুধু এখানেই নয়, সারাদেশকে মাতিয়ে তুলে। বসন্ত বরণ উৎসবকে ঘিরে আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান। এ সব অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। দল-মত নির্বিশেষে উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণীরা সারাদিনই মেতে থাকে প্রাণের এই উৎসবে।
এ ছাড়া বাঙালির বসন্তে যোগ হয়েছে একুশ। এই ফাল্গুন মাসে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে বাঙালি। থোকা থোকা ফুল হয়ে ফুটে আছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিক। সেই বায়ান্ন থেকে প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে একুশে বইমেলা। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজিত গ্রন্থমেলা বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠেছে। গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে মানুষের যে ঢল নামে তাতেও পাওয়া যায় প্রাণের ছোঁয়া।
বসন্তে সংযোজন ঘটেছে ভ্যালেন্টাইনস ডে অর্থাৎ ভালোবাসা দিবস। বসন্তকালে হওয়ায় বাঙালি এই দিনটিকে লুফে নিয়েছে। মন কেমন করা ঝিরিঝিরি উদাসী হাওয়া, পাখপাখালির কুজন ও হাজারও রঙের খেলা নিয়ে প্রকৃতির যে আনন্দ বিহার তাতে ভালোবাসা থাকবে না, তা কী করে হয়? ভ্যালেন্টাইনস ডে না থাকলেও আমাদের বসন্তই তো ভালোবাসা দিবস। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এ অঞ্চলে বসন্ত উৎসব পালিত হতো।
এ প্রসঙ্গে নওগাঁ একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারী ঢাকাপ্রকাশে-কে বলেন, উত্তর জনপদের জেলা নওগাঁয় কালের বিবর্তনে প্রকৃতিকে রাঙিয়ে তোলা আগুন ঝরা ফাগুনে চোখ ধাঁধানো গাঢ় লাল রঙের অপরূপ সাজে সজ্জিত বসন্তের রুপকন্যা পলাশ-শিমুল বিলুপ্তপ্রায়। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতিকে রাঙিয়ে অনেক ফুল ফুটলেও এখন আর তেমন চোখে পড়েনা রক্তলাল নয়নাভিরাম পলাশ-শিমুল ফুল। বিগত এক-দেড় যুগ আগেও জেলার বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির আনাচে কানাচে অনেক পলাশ-শিমুল গাছ দেখা গেলেও এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। এক সময় প্রতিটি গাছে গাছে প্রস্ফুটিত শিমুল ফুলই স্মরণ করিয়ে দিতো বসন্তের আগমন।
তিনি আরও বলেন, পলাশ-শিমুল গাছ রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা না নিলে এক সময় উপকারী গাছের তালিকা থেকে এ গাছটি হারিয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ত জানতেও পারবে না বাংলার মাটিতে শিমুল নামের কোন গাছ ছিল।
আরএ/