বেলের মালা তৈরিতে শতাধিক নারীর জীবন-জীবিকা
মাগুরার মহম্মদপুরের বাবুখালি ইউনিয়নের সেলামতপুর গ্রামে বেলের মালা তৈরি করে জীবন-জীবিকা করছেন শতাধিক নারী। নারীদের নিঁখুত হাতের এই মালা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও যাচ্ছে । হিন্দুদের বিয়েতে এই মালা বেশি ব্যবহার হয়।
সেলামতপুর গ্রামে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় ,বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় হিন্দু নারীরা তাদের গৃহস্থালির ফাঁকে ফাঁকে এ কাজ করছেন । কেউ কেউ আবার বেলের মালা তৈরির কাজ পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন । সকাল থেকে দুপুর কিংবা বিকালে কাটা হয় এই মালা ।
সেলামতপুর গ্রামের এক নারী মিনতী বিশ্বাস জানান, আমি ১০ বছর ধরে এই বেলের মালা কাটছি । আমার গৃহস্থলির কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি এই কাজ করি । একটি বেল দিয়ে ২টি মালা তৈরি হয় । ৮০টি মালায় হয় ১
পোন। আর বাজারে ১ পোন মালার পাইকেরি দর ৩০০ টাকা । বিভিন্ন স্থানের মালার মহাজনরা এই মালা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায় ।
তিনি আরও জানান, হিন্দুদের বিয়েতে বেলের মালা বেশি চলে । বিয়েতে এ মালা ছাড়া হয় না । তাছাড়া বিভিন্ন মেলা আসলে আমাদের বেলের মালার চাহিদা বাড়ে । বর্তমান বাজারে বেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা বেল সংগ্রহ করতে পারছি না । কারণ বেল সব মৌসুমে পাওয়া যায় না । এখন বেল পাওয়া যাচ্ছে । তাই আমরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে বেল সংগ্রহ করছি । তারপর সারাবছর বেলের মালা তৈরি করি । আমার এ কাজে আমার পরিবারের লোকজন সহযোগিতা করে।
একই গ্রামের মালা কারিগর বিষ্ণু প্রিয়া বলেন,৪০ বছর ধরে এই মালা কাটার কাজ করছি । আমার নিজের কোনো জমি নেই । শুধুমাত্র বসতবাড়িটুকু আছে । বর্তমানে বেলের সংকট থাকায় আমরা আগের মতো বেশি পরিমাণে মালা কাটতে পারছি না ।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে বাঁশের একটি ছোট লাঠির মাথায় ছাতার চিকন শিক লাগানো হয় । লাঠিতে একটি শক্ত সুতলি লাগানো হয় যেন লাঠি ঘোরানোর সময় ছিড়ে না যায় । একটি বেলের ভিতরের অংশতে প্রথমে মালার ছক তৈরি করা হয় । এরপর বেলের উল্টোদিকে আবার লাঠি ঘুরিয়ে কাটা হয় মালা । এক একটি খুব ক্ষুদ্র আকৃতির হয় । এই ক্ষুদ্র মালাগুলো রাখা হয় একটি সরায় । তারপর বাঁশের চিকন কাঠির মধ্যে কাটিমের সূতার সাহায্যে ভরা হয় মালা। চিকন কাঠি বের করে সূতাটি টান টান করলেই মালা তৈরি হয়ে যায় । প্রতিদিন সকাল থেকে আমরা বিকাল পর্যন্ত বেলের মালা তৈরি কাজ করি।
কারিগর বিষ্ণু প্রিয়া বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে আসা মালা মহাজনরা আমাদের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে এই মালা। ১ পোন মালা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় আমরা বিক্রি করি । বর্তমানে সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা নানা সমস্যার মধ্যে আছি । সরকার থেকে আমরা (মালার কারিগর) কোনো সহযোগিতা পায় না । তা ছাড়াও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কোনো সহযোগিতা আমরা পাই না। ফলে অনেক সময় আমাদের পরিবার চলে না ।
এ কাজে জড়িত অপর কারিগর নয়ন তারা জানান,৩০ বছর ধরে এ কাজের সঙ্গে আমি জড়িত । বর্তমানে মালা তৈরি করে আমাদের পরিবার চলছে না । মহাজনরা আমাদের কাছ থেকে কম দামে কিনে তারা বেশি দামে বিক্রি করছে। আমরা ১ পোন মালায় ৩০০ থেকে সব্বোর্চ ৪০০ টাকা দাম পাচ্ছি কিন্তু মহাজনরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় মালা বিক্রি করছে । ফলে উপযুক্ত দাম না পেয়ে অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিয়েছে । কারণ বেলের মালা তৈরিতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। প্রথমে বেল সংগ্রহ করে তা রোদে শুকাতে হয় । তারপর তৈরি হয় মালা । ভালো বেল হলে একটি বেলের আচা থেকে ৩ থেকে ৪টি মালা তৈরি হয় । এক্ষেত্রে বেলের আচা অবশ্যই শক্ত ও পরিপক্ক হতে হবে।
এ ব্যাপারে বেলের মালার মহাজন দেব দুলাল বিশ্বাস জানান,আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলায় । আমরা মহম্মদপুরের সেলামতপুর গ্রাম থেকেই বেশি মালা সংগ্রহ করি । কারণ এই গ্রামের অধিকাংশ ঘরে মালা তৈরি হয়। ১ পোন মালা আমরা ৩০০ টাকায় সংগ্রহ করি। মালার মান ভালো হলে ৪০০ টাকাও কেনা হয় । এ মালা আমরা বিভিন্ন মেলায়, কির্তন উৎসব ও বিয়েতে বিক্রি করি । তাছাড়া বেলের মালা পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর, নড়াইল, রাজবাড়ি, কদমবাড়িসহ ঢাকা-খুলনায় মহাজনদের কাছে বিক্রি করা হয় । দিন দিন বেলের মালার চাহিদা বাড়ছে । এই শিল্পকে বাচিঁয়ে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
মহম্মদপুর উপজেলার বাবুখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মীর সাজ্জাদ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের ইউনিয়নের সেলামতপুর গ্রামে প্রায় শতাধিক নারী এ বেলের মালা তৈরির কাজ করে আসছে। তাদের তৈরি এ মালা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। আমরা তাদের সব সময় উৎসাহিত করে আসছি। তাদের অধিকাংশ দরিদ্র। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাদের বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করা হয়। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন রাখব যাতে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হয়।