ইতিহাসের সাক্ষী শাহ মাহমুদ মসজিদ
মসজিদ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য শুধু সৃষ্টিকর্তার আরাধনার স্থানই নয়, মুসল্লিদের মিলনস্থলও বটে। এ ছাড়া প্রাচীন স্থাপনার মধ্যে অন্যতম হলো মসজিদ। বিভিন্ন আমলে নির্মিত প্রাচীন মসজিদগুলো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিশোরগঞ্জের অতি প্রাচীন শাহ মাহমুদ মসজিদটি এগুলোর অন্যতম।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুর গ্রামে অবস্থিত অতি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মসজিদ এটি। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ'র আমলে ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদ নির্মাণ করেন বণিক শেখ মাহমুদ শাহ। তার নামেই মসজিদটির পরিচিতি। তিনি জীবনের প্রথম দিকে খুব দরিদ্র ছিলেন। ফকির নিরগিন শাহের অনুগ্রহে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে একসময় প্রচুর ঐশ্বর্যের মালিক হন তিনি।
এই মসজিদ কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে মঠখোলা-মির্জাপুর-পাকুন্দিয়া সড়কের পাশে অবস্থিত। এটি ঈসা খাঁর দুর্গ থেকে প্রায় ২৫০ মিটার দূরত্বে অবস্থিত। মূল পাকা রাস্তা থেকে আঁকাবাকা মাটির সরু রাস্তা দিয়ে চললেই দেখা মিলবে এই মসজিদের।
শাহ মাহমুদ মসজিদের প্রধান বিশেষত্ব হলো, এর প্রবেশদ্বার। ঠিক দোচালা ঘরের আকৃতি। এই ঘর বা বালাখানার জন্য মসজিদটির আকর্ষণ ও সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়েছে। এই বালাখানার মাঝখান দিয়ে প্রবেশ করে মসজিদে যেতে হয়। ছনের কুটিরের মতো অত্যন্ত আকর্ষণীয় পাকা দোচালা বালাখানাটি দৃষ্টিনন্দন।
মসজিদের উপরে একটি বিশালাকার গম্বুজ রয়েছে এবং এখানকার পূর্বদিকের দেয়ালে টেরাকোটার কাজ ছাড়াও দেয়ালের উপরে, কলামে ও মিনি মিনারে সে আমলের ব্যয়বহুল নকশার কাজ রয়েছে। চারপাশে আড়াইফুটি দেয়াল ঘেরা একটি উঁচু প্লাটফর্মে ৪০০ বছর আগে নির্মিত এই মসজিদে রয়েছে মোঘল শিল্পরীতি ও স্থানীয় শিল্পরীতির নিপুণ সমন্বয়।
এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকৃতি এই মসজিদের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট, যার চার কোণায় আট কোণাকৃতির বুরুজ রয়েছে। মসজিদের ভেতরের প্রতিটি দিকের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৭৯ মিটার। মসজিদের প্রত্যেক টাওয়ারগুলোতে ছোট কক্ষ ছিল। মসজিদের মাঝখানের মিহরাব ও দরজা অন্যান্য মিহরাব ও দরজাগুলোর চেয়ে আকারে বড়। মসজিদের প্রাচীর এবং কার্নিশগুলো মুঘল স্থাপত্যের মতো সমান্তরাল। মসজিদের ভেতর ও বাইরের রয়েছে পোড়ামাটির চিত্রফলক এবং পূর্বের দেয়ালে ৩টি দরজা রয়েছে। এই মসজিদের ভেতরে একসাথে ২৫ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে।
তা ছাড়াও কারুকার্যখচিত নকশা মসজিদের ভেতরের অংশকে করে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন। ইটের তৈরি মসজিদটির মূল গম্বুজের ভেতরের দিকে পদ্ম ফুলের নকশা ও গম্বুজের উপরের দিকে কলসি আকৃতির চূড়া রয়েছে। অনেক আগে মসজিদের চার কোণায় চারটি মূল্যবান প্রস্তর ফলক ছিল যা বর্তমানে নেই। এ ছাড়াও মসজিদের সম্মুখভাগের চারটি চূড়ার নকশার উত্তর ভারতের ফতেহপুর, আগ্রা ও দিল্লির মুঘল আমলের মসজিদগুলোর পারস্য নকশার সঙ্গেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই মসজিদের আঙিনায় রয়েছে কয়েকটি প্রাচীন কবর।
এগারসিন্দুর মাদরাসার একজন শিক্ষক জানান, এগারসিন্দুরের বিভিন্ন গ্রামে ঐতিহ্যের অনেক স্মৃতিবিজড়িত দর্শনীয় স্থান রয়েছে।দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এইসব ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে আসে। এই গ্রামের মানুষ হিসেবে আমার গর্ব হয়।স্থানীয়রা জানায়,পূর্বে এই মসজিদ অনেক দৃষ্টিনন্দিত ছিলো।এখনও মসজিদে ইবাদত করার জন্য দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসে।প্রত্নতাত্বিক অধিদপ্তরের আওতায় আনার পর এই মসজিদের সংস্কার কাজ করা হয়েছিল কিন্তু পুরো মসজিদটি সংস্কারে ব্যর্থ হয়।
ঢাকা থেকে আসা দর্শনার্থী সুমন আহমেদ জানান, অনেক পুরোনো মসজিদের নাম শুনে মসজিদে নামাজ পড়তে ও দেখতে এলাম। মসজিদটি খুব সুন্দর এখানে আসতে পেরে ভালো লাগল। আমার জানা মতে, ৫০০ বছর আগে তৈরি মসজিদ দেশের অন্য কোনো স্থানে নেই।
বর্তমানে মসজিদের ইমাম আরিফ বিল্লাহ্ বলেন, আমাদের বাপ-দাদাদের মুখে শুনেছি মসজিদটি ৪০০ বছরের পুরোনো। এখানকার ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা এই মসজিদেই নামাজ আদায় করে। অনেক পুরোনো মসজিদ দেখতে প্রতিদিনই মানুষ এই গ্রামে আসে।
এসএন